Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

সেহেরিতে আজও থাকে বিরিয়ানি

নবাব নেই। নেই সেই নবাবিও। তবুও এক সময়ের বাংলা-বিহার-ওড়িশার রাজধানী মুর্শিদাবাদ (লালবাগ)-এ নবাবি আমলের ইফতারি ও সেহিরির ট্রাডিশান আজও সমানে চলছে।দৈনিক শ’দুয়েক লোকের ইফতার আর তার সঙ্গে সেহেরি বলে কথা!

ইফতারের রুটি। গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।

ইফতারের রুটি। গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।

অনল আবেদিন
লালবাগ শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০১৬ ০৭:০৮
Share: Save:

নবাব নেই। নেই সেই নবাবিও। তবুও এক সময়ের বাংলা-বিহার-ওড়িশার রাজধানী মুর্শিদাবাদ (লালবাগ)-এ নবাবি আমলের ইফতারি ও সেহিরির ট্রাডিশান আজও সমানে চলছে।

দৈনিক শ’দুয়েক লোকের ইফতার আর তার সঙ্গে সেহেরি বলে কথা! ফলে হাজারদুয়ারি প্যালেস ও মিউজিয়ামের মুখোমুখি ঐতিহাসিক ইমামবাড়ায় নবাবি ঘরানার সেই ইফতারি ও সেহরি প্রস্তুতের আয়োজন শুরু হয় প্রতিদিন সকালে। উনুন জ্বলে দিনভ’র।

রোজার নিরম্বু উপবাস শুরুর আগে ভোর রাতের খাবার, সেহেরি খেতে হয়। তার জন্য তন্দুর বসিয়ে তৈরি হয় নাদ রুটি, বানজারি ডাল, আলুকোর্মা। মটন বিরিয়ানিও রান্না হয় সেই ইমামবাড়ার ভিতরে। সেখানেই নানা রকম ফল, তেলেভাজা ও মুড়ি দিয়ে সাজানো হয় ইফতারের থালা। ফি বছর এক মাস ধরে সেই ইফতারি ও সেহরির খরচ যোগায় রাজ্য সরকারের আইন দফতরের অধীনে থাকা ‘মুর্শিদাবাদ এস্টেট’। সরকারি উদ্যোগে রাজ্যে আর কোথাও সেহেরি ও ইফতারির এমন নজির নেই।

মুর্শিদাবাদ এস্টেটের পক্ষ থেকে শিয়া সম্প্রদায়ের মোট ২৩টি ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা হয়। তার মধ্যে আরবি চান্দ্রমাস অনুসারে রমজান মাসব্যাপী পালন করা হয় রোজার উপবাস। রোজা ও ইদ-সহ মুর্শিদাবাদ এস্টেটের তালিকায় থাকা মোট ২৩টি ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করার জন্য জন্য রয়েছে নানা ধরণের পদাধিকারী। এস্টেটের তহবিল থেকে তাঁদের ভাতাও দেওয়া হয়। এস্টেট ম্যানেজার সৌর মণ্ডল বলেন, ‘‘রোজার উপবাস শুরু করার জন্য সূর্যোদয়ের কয়েক ঘণ্টা আগে সেহেরি খেতে হয় ও সূর্যাস্তের সময় উপবাস ভাঙার জন্য ইফতারি করতে হয়। নবাবি আমল থেকে পবিত্র রমজান মাস জুড়ে ইমামবাড়ার সুপারের তত্ত্বাবধানে সেহেরি ও ইফতার বিতরণের প্রথা চলছে। মুর্শিদাবাদ এস্টেটের তালিকায় থাকা বেরা ও মহরম-সহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানও একই ভাবে পালন করা হয়।’’ নবাবরা শিয়া সম্প্রদায়ভূক্ত হওয়ায় ইসলাম ধর্মের শিয়া সম্প্রদায়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালনের জন্য মুর্শিদাবাদ এস্টেট থেকে অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা রয়েছে।

রোজার মাসে ইফতারি ও সেহেরি বিলি করা নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। তার মধ্যে বহুল প্রচলিত কাহিনিটি নবাব ওয়াশেফ আলি মির্জাকে ঘিরে। তখন ব্রিটিশ শাসন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ছাত্র ওয়াশেফ আলি মির্জা রোজার উপবাস করতে পারতেন না। ইমামবাড়ার সুপার সৈয়দ জামিল মির্জা নবাব পরিবারের বর্তমান বংশধরদের অন্যতম। জামিল মির্জা বলেন, ‘‘নবাব ওয়াশেফ আলি মির্জা রোজার উপবাস না করতে পারার কারণে ধর্মীয় নিয়মনীতি মেনে নবাবের বদলে ৬০ জনকে রোজা রাখতে হত। সেই ৬০ জন রোজদারের কাজু, কিসমিস, আখরোট, আপেল- সহ নানা ফলের এলাহি ইফতার ও নবাবি স্বাদের বিরিয়ানির সেহেরির ব্যবস্থা করতেন খোদ নবাব নিজেই।’’ লালবাগে সেই ট্রাডিশান আজও সমানে চলছে।

এখন ষাটের বদলে রোজদারের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে শ’দুয়েক। কখনও তারও বেশি। ইমামবাড়ার সহকারি সুপার কামবার আলি জানান, তবুও চেষ্টা করা হয়, যাতে ইফতারের থালায় আপেল, কলা, নাসপাতি, ছোলার ঘুগনি, বেগুনি ও মুড়ি যেন থাকে। জিভের স্বাদ বদল করতে থাকে বিশেষ উপকরণ দিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে রান্না করা টক জাতীয় পদ কাচালু। সেই ইফতারের পসরা চলে যায় ইমামবাড়া ও হাজারদুয়ারির অদূরে মিরজাফরের স্ত্রী মুন্নি বেগম প্রতিষ্ঠিত চক মসজিদে। সূর্যাস্তের সময় সেখানে বসে বিশাল ইফতার মজলিস। তার আগে বিকালে ইমামবাড়ায় সমবেত হন লালবাগের চক, বকরি গলি, রাজাবাজার, জুবলি ট্যাঙ্ক, কুতুপুর-সহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত নবাব পরিবারের পাশাপাশি অন্য রোজদাররা। ওই রোজাদারদের সেহেরির জন্য তাঁদের হাতে তুলে দেওয়ায় হয় নাদ রুটি।

ওই তন্দুরি রুটির সঙ্গে কোনও দিন দেওয়া হয় পুদিনা পাতা ও গাওয়া ঘি দিয়ে রান্না করা বানজারি ডাল। কোনও দিন আলু কোর্মা। কোনও দিন ছোলার ডালের ডালনা। ইমামবাড়ার সুপার সৈয়দ জামিল মির্জা বলেন, ‘‘নবাবি আমলে প্রতিদিন দেওয়া হত নবাবি বিরিয়ানি। খাঁটি গাওয়া ঘিয়ের শাহি বিরিয়ানির স্বাদই আলাদা। তার বেহশতি খুশবুতে কেল্লা নিজামত এলাকা ম ম করত! এখন আর সেই নবাব নেই। নেই নবাবিও। মুর্শিদাবাদ এস্টেটের আর্থিক সামর্থ্যও আগের থেকে অনেকটাই কমে গিয়েছে। কিন্তু ঐতিহ্য রক্ষা বলে কথা! তাই সেহেরির জন্য ২৮ দিন ডাল-রুটি-আলুর কোর্মা দেওয়া হলেও ২ দিন মটন বিরিয়ানি দেওয়া হয় আজও।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Iftar Food lalbagh murshidabad
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE