বিশাল স্টেডিয়ামে খেলার জন্য হাজির হাতেগোনা খেলোয়াড়। — নিজস্ব চিত্র।
হাতের মুঠোয় একটা স্মার্টফোন। হাজারটা গেম-অ্যাপের ছড়াছড়ি। পছন্দ মতো একটা বেছে নিলেই হল। তারপর যখন খুশি ডাইনে-বাঁয়ে বল কাটিয়ে বিপক্ষের গোল পোস্ট লক্ষ করে একটা জব্বর শট। জালে বল জড়ালেই গ্যালারি কাঁপানো আওয়াজ—গো...ও...ও...ল। তরতর করে বাড়ছে গেম পয়েন্ট। চারদিক থেকে হাজার হাততালি আর অভিবাদনের বন্যায় কোথায় লাগে মেসি-রোনাল্ডো!
এ সবটাই যদি মোবাইলে হয়ে যায় তাহলে খামোকা খেলার জন্যে মাঠে যাওয়ার দরকারটা কী? নতুন প্রজন্মের এমন প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই শহরের প্রবীণদের কাছে। গায়ে ধুলো-কাদা মেখে, ঘাম ঝরানো প্র্যাক্টিস থেকে ক্লাবের হয়ে কাপ জেতা পর্যন্ত পুরো ব্যাপারটাই এখন তাঁদের কাছে কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কিছুটা অর্থহীনও।
যে বেলডাঙায় এক সময়ে রমরমিয়ে চলত ফুটবল টুর্নামেন্ট সেখানে এখন খেলোয়াড়ই মেলে না! বন্ধ হয়ে গিয়েছে বীণাপানি চ্যালেঞ্জ শিল্ড, হাজি নকিবুদ্দিন মেমোরিয়াল কাপ ফুটবল কিংবা উপেন গুহ মেমোরিয়াল কাপের মতো সেইসব এলাকা কাঁপানো টুর্নামেন্ট। শহরের প্রবীণদের আক্ষেপ, আগে খেলোয়াড় ছিল বেশি। মাঠ তুলনায় কম। এখন মাঠ থাকলেও আগের মতো খেলোয়াড় নেই।
কথাটা কিন্তু কথার কথা নয়। শহরে খেলার উপযুক্ত মাঠ রয়েছে সাতটি। কিন্তু তার মধ্যে তিনটি মাঠ সকাল বিকেল ভোঁ ভোঁ করে। অন্য দিকে, স্টেশন সংলগ্ন একটি মাঠ জবরদখলের জেরে হারিয়ে যাওয়ার পথে। বাকি দু’টো মাঠ—১২৫ বছরের পুরানো কাশিমবাজার রাজ গোবিন্দ সুন্দরী বিদ্যাপীঠের ময়দান ও বড়ুয়া যুবক সঙ্ঘের মাঠে যা একটু খেলাধূলা হয়। বড়ুয়া কলোনির তরুণ সঙ্ঘ মাঠে খেলাধূলার চর্চা হয় বটে। তবে তা নিয়মিত নয়। এ ছাড়াও শহরের নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে একাধিক মাঠ। কিন্তু কোনওটাতেই নিয়মিত খেলাধূলা হয় না। শ্রীশচন্দ্র মাঠ, কলেজ মাঠ ও শরৎপল্লি বালিকা বিদ্যালয়ের মাঠ খেলার উপযুক্ত হলেও খেলার কেউ নেই।
শহরে খেলার গুরুত্ব কমছে কেন?
বেলডাঙা বড়ুয়া কলোনির বাসিন্দা এক সময়ে মুর্শিদাবাদ একাদশ দলের খেলোয়াড় সত্তরোর্ধ্ব রঞ্জিৎ সেনের আক্ষেপ, ‘‘দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে মানুষের রুচি, জীবনযাত্রার ধরণ। বতমার্ন প্রজন্ম খেলার বদলে মাঠে বসে আড্ডা মারতে বেশি উৎসাহী। মাঠে বসেই মোবাইলে গান বাজায়। মায় ফুটবলটাও খেলে মোবাইলে! এ সব দেখে মাঠে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি।’’ ‘‘তবে এখনও কিছু কিছু জায়গায় খেলাধূলার একআধটু চর্চা হয়। গোবিন্দ সুন্দরী বিদ্যাপীঠ ও যুবক সঙ্ঘের মাঠে খেলাধূলা চলে। এই চর্চাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দরকার।’’— মত তাঁর। জেলার প্রাক্তন ফুটবলার বছর ছিয়াত্তরের আদিত্য মুন্সি বলেন, ‘‘আগে টুর্নামেন্টে এলাকার ছেলেরাই খেলত। কিন্তু এখন সব টুর্নামেন্টেই বাইরের খেলোয়াড়কে দিয়ে খেলানো হয়। দেখে খুব কষ্ট হয়।’’
জেলার স্থানীয় খেলোয়াড়দের নিয়ে সবচেয়ে বড় ফুটবলের আসর বসে কামদাকিঙ্কর গোল্ড কাপ ফুটবলকে কেন্দ্র করে। সেই টুর্নামেন্টে গত ২০১২ ও ২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়ন দল ছিল বেলডাঙা কোচিং ক্যাম্প। সম্পাদক আরফাত শেখ বলেন, ‘‘খেলার লোক নেই কথাটা পুরো ঠিক নয়। পরিবেশ না পেয়ে অনেকেই বহরমপুর ও কলকাতায় যেতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে আমরা স্থানীয় ছেলেদের নিয়ে নিয়মিত ফুটবলের কোচিং করাই।’’ তিনি বলেন, ‘‘বেলডাঙার ঐতিহ্যবাহী বীণাপানি চ্যালেঞ্জ শিল্ড দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকার পর পুরসভার উদ্যোগে দু’বছর চালু হয়েছিল। কিন্তু নানা কারণে তা আবার বন্ধ হয়ে গেল। আবার তা চালু করার চেষ্টা হচ্ছে।’’
যাঁরা বর্তমানে সক্রিয় ভাবে খেলার জগতের মধ্যে রয়েছেন তাঁদের অন্যতম বেলডাঙা যুবক সঙ্ঘের সম্পাদক মহম্মদ আলাউদ্দিন জানান, তাঁদের নবনির্মিত স্টেডিয়ামে হাওড়া থেকে এক জন কোচ আসেন নানা বয়সের ফুটবল খেলোয়াড়রা বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দিতে। তিনি বলেন, ‘‘শহরে ত্রিশ বছরের বেশি ধরে রমজান আলি মজিবুর রহমান স্মৃতি নক আউট ফুটবল চলছে। প্রচুর মানুষকে ফুটবলমুখী করতে পেরেছি। শহরে ফুটবল জনপ্রিয় হয়েছে।’’
ফুটবলের প্রাক্তন রাজ্যস্তরের রেফারি তথা বেলডাঙার পুরপ্রধান কংগ্রেসের ভরত ঝাওর বলেন, ‘‘বতমার্ন প্রজন্ম কিছুটা কেরিয়ারমুখী। তবে তাঁরা একেবারে খেলছে না বলব না। তবে আমাদের সময় স্কুল থেকে ফিরেই বল নিয়ে মাঠে যাওয়ার চল এখন আর নেই।’’ ‘‘আমরা পুরসভার পক্ষে কয়েকটি মাঠ সংস্কারের ব্যপারে ভাবনা চিন্তা করব। তবে প্রাচীন বীণাপানি চ্যালেঞ্জ শিল্ড যে পরিবারের দ্বারা শুরু হয়েছিল তাঁদের এগিয়ে আসতে হবে। না হলে পুরসভার পক্ষে অত বড় আর্থিক ব্যয়ভার একা বহন করা সম্ভব নয়। যৌথ ভাবে উদ্যোগী হলে ওই কাপ চালু হতেই পারে।’— বলছেন ভরতবাবু।
শহরে খেলার সুদিন ফিরবে কিনা সময় বলবে। তবে বৃষ্টির পরে মাঠের সবুজ ঘাস কিন্তু খেলোয়াড়দের জন্য আজও মাথা তুলে অপেক্ষায় রয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy