প্রতীকী ছবি।
দুর্গাপুজোর রেশ কাটতে না কাটতেই চলে এল কালীপুজো। জেলার কুপার্স ক্যাম্প, ধুবুলিয়া, হরিণঘাটা-সহ বেশ কিছু এলাকার প্রধান উৎসবই হল কালীপুজো। আর এই পুজোয় শিশুরা নতুন জামা-কাপড় পড়ে বাবা-মার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে মণ্ডপে। পরিবারের সকলে বাইরেই সেরে নেন রাতের ভুরিভোজ। আবার, কোনও স্কুল পড়ুয়া বাবা-মায়ের সঙ্গে এই ছুটিতে বেড়াতে গিয়েছে পাহাড় বা সমুদ্রে। কিন্তু জেলার অনেক শিশুর কাছেই এ সব নেহাতই কল্পনা।
কল্যাণী থেকে কালীগঞ্জের বহু খাবারের দোকানেই কাজ করে চলেছে শিশুরা। কেউ আবার ইটভাটাতে বাবা-মায়ের সঙ্গে কাজ করে। শহরের বিভিন্ন মোটরবাইকের সার্ভিসিং সেন্টারে গাড়ি ধুতে ব্যস্ত রয়েছে ওদের কেউ।
ওদের কোনও শৈশব নেই। পুজো আর বছরের অন্য দিনগুলির মধ্যে ফারাক করতে জানে না ওই শিশুশ্রমিকেরা।
বেশ কয়েক বছর ধরে কল্যাণীর জেএনএম হাসপাতালের পিছনে তাঁবু খাটিয়ে থাকে গোটা পঞ্চাশেক পরিবার। তাদের না রয়েছে মাথার উপর ছাদ, না আছে শৌচালয়। আর ভিন্প্রদেশ থেকে আসা ওই সব দিনমজুর পরিবারের শিশুরা সকাল হলেই শিল্পাঞ্চল-স্টেশনের আশপাশের বিভিন্ন দোকানে কাজে ঢুকে পড়ে। বিনিময়ে জোটে দুপুরের সামান্য পরিমাণ ডাল-ভাত।
হরিণঘাটার নিমতলা বাজারে একটি হোটেলে যেমন এই পুজোর মধ্যেও কাজ করছে শ্যামল দাস নামে বছর বারোর একটি শিশু। কালীপুজোর সকালে দেখা গেল, সে একমনে এঁটো থালা ধুতে ব্যস্ত। আর তার ফাঁকে দৌড়ে দৌড়ে খাবারের টেবিলও পরিষ্কার করে নিচ্ছে।
কালীপুজোয় আনন্দ করতে ইচ্ছা করে না? কিংবা বাজি পোড়াতে?
এই প্রশ্নের উত্তরে চোখে জল চলে আসে শ্যামলের। জানাল, বাবা-মা মারা গিয়েছে ছোটবেলায়। মামার বাড়ি কোনওরকম মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে। কিন্তু সেখানে দু’বেলা খাবার জোটে না। তাই বাধ্য হয়েই সকালে চলে আসতে হয় হোটেলে। রাতে যখন এই হোটেলেই তার বয়েসি ছেলেমেয়ে মা-বাবার হাত ধরে এসে খাওয়া-দাওয়া করবে, সে তখনও কাজ করে যাবে।
নাকাশিপাড়ার চ্যাঙার বাসিন্দা জাইদুল হক জানাচ্ছেন, বেথুয়াডহরি বাজারে রয়েছে একাধিক খাবারের দোকান। সেখানেও শিশুদের দিয়ে সারা বছরই কাজ করানো হয়।
কল্যাণীর সেন্ট্রাল পার্কের একটি মোটরবাইক সার্ভিসিং সেন্টারে গিয়ে দেখা গেল, বছর তেরোর এক কিশোর গাড়ি ধুতে ব্যস্ত। সে জানায়, দুর্গাপুজোর সময়েও তাকে এ ভাবেই কাজ করতে হয়েছে। আবার একটা পুজো এল। এবারও সেই একই রুটিন। একঘেয়েমি জীবন। কাজ করা থেকে নিস্তার নেই। সারা দিনে অন্তত ১০টি গাড়ি ধুতে হয় তাকে।
অথচ, শিশুশ্রম বিরোধী আইনে স্পষ্ট বলা রয়েছে, ১৪ বছরের কম বয়সী কোনও শিশুকে দিয়ে কাজ করানো যাবে না। এমনকি, কোনও বাড়িতেও শিশুদের দিয়ে কাজ করানো চলবে না। ২০১৬ সালে ওই আইন সংশোধন করে বলা হয়, শুধু ১৪ বছর পর্যন্ত শিশুরাই নয়, বয়ঃসন্ধিকালীন কোনও কিশোর-কিশোরীকে দিয়েও বিপজ্জনক কাজ করানো যাবে না।
শ্রম দফতরের পরিদর্শক পলাশ সরকার বলছেন, ‘‘দফতর থেকে মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন জায়গায় হানা দিয়ে শিশুশ্রমিকদের উদ্ধার করা হয়। তার পর বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে শিশুশ্রমিকদের স্কুলে পাঠানো হয়।’’ যদিও কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র সরিফুল ইসলাম বলছেন, ‘‘এই দেশে এখনও বহু মানুষ দু’বেলা খেতে পান না। তাঁরা তো বাচ্চাদের কাজে পাঠাবেনই। এই অভিভাবকদের কাছে শিক্ষার কোনও মূল্য নেই।’’ তাই দীপাবলিতে যখন ছোট ছোট হাতে জ্বলে ওঠে প্রদীপ, তখনও তার নীচে থেকে যায় কিছু জমাটবাঁধা চিরকালীন অন্ধকার। শিশুশ্রমের লজ্জাজনক অন্ধকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy