সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিজেপির গ্রহণযোগ্যতা এখনও সেভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। মুর্শিদাবাদের পুর নির্বাচনে জেলার সব ওয়ার্ডে প্রার্থী দিতে না পারার এটাই অন্যতম কারণ বলে মানছে বিজেপি নেতৃত্ব। বিজেপির মুর্শিদাবাদ জেলার সম্পাদক মেহেবুব আলম বলছেন , ‘‘এ জেলার শহরাঞ্চলের সংখ্যালঘুদের মধ্যে আশানুরূপ ভাবে সাড়া পাইনি বলেই পুরসভাগুলিতে প্রার্থী দিতে পারিনি।’’
পড়শি জেলা বীরভূমে পুরভোটে চারটি পুরসভায় ৭৩টি আসনের সবক’টিতেই প্রার্থী দিয়েছে বিজেপি। সেখানে মুর্শিদাবাদে ছ’টি পুরসভায় মোট ১০৭টি আসন রয়েছে। প্রতিটি আসনেই লড়ছে বামেরা। মহাজোটের জন্য একটি আসন ছেড়ে দিয়ে বাকি সবক’টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে তৃণমূল। কংগ্রেস প্রার্থী দিয়েছে ১০৩টি আসনে। সেই জায়গায় বিজেপি লড়ছে মাত্র ৭৫টি আসনে। সংখ্যালঘু প্রার্থী সাকুল্যে ১০! তার মধ্যে ছ’জনই জঙ্গিপুর পুরসভার। এ দিকে ৭৯ শতাংশ সংখ্যালঘু অধ্যুষিত ধুলিয়ানে ২১টি ওয়ার্ডে মাত্র সাতজন প্রার্থী রয়েছে বিজেপির। এঁদের মধ্যে সংখ্যালঘু মুখ স্রেফ দুই। ৬৩ শতাংশ সংখ্যালঘু রয়েছে বেলডাঙায়। সেখানে বিজেপির ১১ জন প্রার্থীর মধ্যে সংখ্যালঘু মাত্র এক। একই ছবি জিয়াগঞ্জ–আজিমগঞ্জেও। সেখানেও ১৬ জনের মধ্যে একজন সংখ্যালঘু প্রার্থী।
মাদ্রাসা শিক্ষক সংগঠনের রাজ্যের কার্যকরী সভাপতি নুরে খোদা অবশ্য মনে করেন, পাশাপাশি জেলা হলেও নদিয়া-বীরভুম আর মুর্শিদাবাদের মধ্যে রাজনীতিতে চরিত্রগত অনেক ফারাক রয়েছে। ‘‘নদিয়া এবং বীরভুমে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল যথেষ্ট শক্তিশালী। তাদের অত্যাচার থেকে বাঁচতেই তৃণমূলের বিরোধী সংখ্যালঘুরা সেখানে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকারের শাসক দল হিসেবে বিজেপিকে বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। কারণ তাঁরা জানেন, বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস তাঁদের বাঁচাতে পারবে না, যা বিজেপির পক্ষেই সম্ভব।’’ তাঁর যুক্তি, অন্য দুই জেলার মতো একচেটিয়া রাজনৈতিক সন্ত্রাস মুর্শিদাবাদে নেই। তাই এ জেলায় সংখ্যালঘুদের বিজেপির আশ্রয় দরকার হয়নি।
তবে সংখ্যালঘু প্রার্থী দিতে না পেরে বিব্রত জেলা বিজেপি নেতারা। দলের জেলা সাধারণ সম্পাদক তথা দলীয় মুখপাত্র সুভাষ মণ্ডলের বক্তব্যেও উঠে এল সেই অস্বস্তি। তিনি মানলেন, ‘‘ধুলিয়ান-সহ জেলার বিভিন্ন জায়গায় সভা করেছেন দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। সেখানে সংখ্যালঘুদের ভিড় ভালই হয়েছিল। কিন্তু পুর-নির্বাচনে তার কোনও ছাপ পড়ল কই?’’
রাজ্যের মসনদ দখলে ২০১৬-এর বিধানসভা ভোটকে পাখির চোখ করেছে বিজেপি। তার আগে সংগঠনের এমন হাল কেন? দলের জেলা সভাপতি মালা ভট্টাচার্য মানছেন, ‘‘জেলায় দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা অস্বীকার করার নয়। লক্ষাধিক মানুষ বিজেপির সদস্য হয়েছেন জেলায়। এঁদের মধ্যে সংখ্যালঘু খুব যে কম তা নয়। তবু সেই তুলনায় পুর নির্বাচনে সব আসনে প্রার্থী দিতে পারিনি আমরা।’’ বিজেপি সূত্রে খবর, যেখানে দলের শক্তি নেই সেখানে প্রার্থী দিয়ে শক্তিক্ষয় করতে চাননি নেতৃত্ব। তবে লালবাগ, জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ ও বেলডাঙায় ভাল ফলের আশা করছেন নেতৃত্ব। কারণ গত লোকসভা নির্বাচনে ওই তিন পুরসভার অন্তত ১০টি আসনে এগিয়ে থেকেছে বিজেপি।
সুভাষবাবু কবুল করছেন, ‘‘জেলায় দলীয় নেতা ও কর্মীদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে বিস্তর। এগুলি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। দলে সংখ্যালঘু সেল থাকলেও জেলায় তা তেমন সক্রিয় নয়। তাই পাশের জেলা বীরভূমে যে ভাবে সংখ্যালঘুরা বিজেপির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, এ জেলায় তা হয়নি।’’
সম্প্রতি বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের সভায় ধুলিয়ানে সংখ্যালঘুদের উপস্থিতি দেখে কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিলেন বিজেপির নেতারা। পুর নির্বাচন নিয়ে দলীয় কর্মীসভায় যোগ দিতে ১১ মার্চ ফের রঘুনাথগঞ্জে আসেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি। দীর্ঘ চার ঘন্টা ধরে রবীন্দ্রভবনে রুদ্ধদ্বার কক্ষে কর্মী বৈঠক সেরে সাংবাদিক বৈঠক করে রাহুলবাবু ধুলিয়ান ২১টি সহ মুর্শিদাবাদের ১০৭টি ওয়ার্ডেই প্রার্থী দেওয়ার কথা ঘোষণাও করেন । কিন্তু শেষ পর্যন্ত বহু চেষ্টা করেও ধুলিয়ানে সাতটির বেশি আসনে প্রার্থী জোগাড় করতে পারেননি দলের নেতারা।
ধুলিয়ান মন্ডলের বিজেপি সভাপতি সুশান্ত সরকার দায়ী করছেন দলের সংগঠনের অভাবকে। তিনি বলেন, ‘‘ধুলিয়ানের সভায় সংখ্যালঘু ভিড় হলেও দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা তো অস্বীকার করা যাবে না। সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিজেপি সম্পর্কে ভীতি কাটিয়ে দলের গ্রহণ যোগ্যতাও বাড়ানো যায়নি সংগঠনের শক্তির অভাবে। যাদের প্রার্থী করব তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও রয়েছে।’’ তিনি জানান, ইতিমধ্যেই ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের এক প্রার্থীর স্বামী তাজমুল সেখকে রবিবার বিকেলে তিন দুষ্কৃতী আক্রমণ করেছে। স্ত্রীকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্যই এই চাপ, মনে করছেন সুশান্তবাবু। ভোটের দিন যত এগিয়ে আসবে বিজেপির উপর এই আক্রমণ আরও বাড়বে। ‘‘এই অবস্থায় ঝুঁকি নিয়ে ধুলিয়ানে প্রার্থী দাঁড় করানো সম্ভব হয়নি,’’ বলছেন তিনি।
ধুলিয়ান শহরের বাসিন্দা শহরেরই একটি হাই স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোজাফফর হোসেন বলেন , ‘‘শহরে সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিজেপির প্রভাব বেড়েছে, তবে তা নিতান্তই সামান্য। আগে ধুলিয়ানে দু-তিনটির বেশি আসনে প্রার্থী দিতে পারত না বিজেপি। এখন দু’জন সংখ্যালঘু সহ সাতজনকে অন্তত দাঁড় করাতে পেরেছে ধুলিয়ানে। এটাই যথেষ্ট। তবে শেষ পর্যন্ত সংখ্যালঘু ভোট কতটা বিজেপি পাবে তা নিশ্চিত নয়।’’
জঙ্গিপুরের একটি মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মহসিন আলি মনে করেন, বিজেপি সম্পর্কে মুসলিমদের মধ্যে যে আশঙ্কা ও ভীতি রয়েছে তা এখনও কাটেনি। বিজেপি কর্মীরা তাঁদের কাজের মধ্যে দিয়ে সেই আস্থাহীনতা দূর করতে পারবে কিনা, সেটাই প্রশ্ন।
বিজেপির মুর্শিদাবাদ জেলার সম্পাদক মেহেবুব আলম অবশ্য দাবি করেন, শহরে সংখ্যালঘুদের গ্রহণযোগ্যতা কম হলেও, গ্রামাঞ্চলে সে অবস্থা নেই। ‘‘আগে তো সংখ্যালঘু মহল্লাগুলিতে ঢুকতেই পারত না বিজেপির কর্মী, নেতারা। এখন মুসলিম-অধ্যুষিত গ্রামে ঢুকে বিজেপি বুথ কমিটি গঠন করছে। ৩১ মার্চ সদস্য সংগ্রহ প্রক্রিয়া শেষ হবে । তখনই স্পষ্ট হবে এ জেলায় সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিজেপি কতটা প্রভাব ফেলেছে।’’ তাই তাঁর আশা, পুর নির্বাচন নয়, ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন বিজেপির কাছে মুর্শিদাবাদে ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy