Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

রং-তুলি কিনে দিতেন আঁকার স্যর

এই বয়সেও প্রতি বছর শিক্ষক দিবসের আগে ছুটে আসেন সে দিনের ওই শিক্ষকের কাছে

ছাত্র ও শিক্ষক। নিজস্ব চিত্র।

ছাত্র ও শিক্ষক। নিজস্ব চিত্র।

সুস্মিত হালদার
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:৪৭
Share: Save:

ক্লাস শেষ হওয়ার পরে ছোট্ট পড়ুয়াকে কাছে ডেকে নেন শিক্ষক। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,“ছুটির পরে দাঁড়িয়ে যাস।”

স্কুলের বাইরে গেটের ধারে দাঁড়িয়ে থাকে সদ্য কিশোর। ক্লান্ত শিক্ষক বেরিয়ে এলে পাশাপাশি হাঁটেন। সোজা গিয়ে ঢোকেন বই-খাতার দোকানে। শিক্ষক একে একে আঁকার নানান সরঞ্জাম কিনে এনে তুলে দেন ছাত্রের হাতে। সে সব হাতে নিয়ে অবাক চোখে ছাত্র তাকিয়ে থাকে শিক্ষকের মুখের দিকে।

আজ সেই কিশোর নিজেই একটি ইংরাজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষক। আজও তাঁর টেবিলে যত্ন করে সাজানো আছে শিক্ষকের কাছ থেকে উপহার পাওয়া সেই প্রথম দিনের তুলি। আজও তিনি সে তুলিতে হাত বুলিয়ে নিজের অজান্তেই কৃতজ্ঞতা জানান ওই শিক্ষককে।

এই বয়সেও প্রতি বছর শিক্ষক দিবসের আগে ছুটে আসেন সে দিনের ওই শিক্ষকের কাছে। প্রণাম জানিয়ে, গুরুদক্ষিণা দিতে চলে আসেন ফুল, মিষ্টি আর উপহার হাতে।

এ ভাবেই চলছে বছরের পর বছর। মাস্টারমশাই বারণ করেন। শোনেন না ছাত্র। চোখের কোণে গড়িয়ে পড়া দু-এক ফোঁটা জলে লেগে থাকে শিক্ষার তুলিতে আঁকা উপযুক্ত মানুষ হওয়ার ছবি।

সে দিনের ওই অভাবী ছাত্র হলেন চাপড়ার রথতলার বাসিন্দা তন্ময় কর্মকার। তাঁর বাবা রঞ্জিত কর্মকার ছিলেন সামান্য বাসচালক। দুই ভাই-বোন। বাবার সামান্য আয়ে কোনওমতে সংসার চালিয়ে সন্তানদের স্কুলের খরচ জোগাতেন। কিন্তু সব সামলে ছেলের আঁকার খরচ চালানো কঠিন হয়ে পড়েছিল।

কিন্তু হাট চাপড়া কিং এডওয়ার্ড হাইস্কুলের ছাত্র ওই ছেলেটি যে আঁকতে ভালবাসে, তা জানতেন এক জন।

তখন কিশোর তন্ময় পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। স্কুলের দরিদ্র পড়ুয়াদের জন্য নানান প্রোজেক্ট শুরু করেছিল স্থানীয় এক সংস্থা। তাদের হয়ে আঁকা শেখাতে আসতেন চাপড়া বাসিন্দা প্রদ্যুৎ দত্ত। এক সময় সেটা বন্ধ হয়ে যায়। তার পরেও উৎসাহী কয়েক জন ছাত্র আঁকা শিখতে এল তাঁর কাছে। বেতন মাসে ২৫ টাকা। কিন্তু তন্ময় কোথায়? খোঁজ করলেন আঁকার স্যর। জানতে পারলেন, তন্ময়ের পরিবার অত্যন্ত দরিদ্র। তাই পয়সা খরচ করে আঁকা শেখা সম্ভব নয়।

বিষণ্ণ হয়ে উঠল ছাত্রদরদী শিক্ষকের মন। ভেবেছিলেন, সামান্য ক’টা টাকা জন্য আঁকা শেখা হবে না ছেলেটার? সেই মুহূর্ত থেকে তন্ময়ের আঁকা শেখার দায়িত্ব নেন প্রদ্যুৎ। তিনি এ দিনে বলেন, “প্রথম থেকেই ছেলেটার মধ্যে আঁকার প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ। যেন মগ্ন হয়ে আঁকত। অন্যদের থেকে কিছুটা হলেও আলাদা ওর হাতের টান!”

একদিন তাই স্কুল শেষে দেখা করতে বললেন ছাত্রকে। কিনে দিলেন রং-তুলি। সেই শুরু। তার পরের সব ক’টা দিন রঙে ভরে উঠল কিশোর তন্ময়ের। তন্ময় বলছেন, “সেই যে স্যর আমায় রং-তুলি কিনে দিলেন, তার পর আর কোনও দিন ভাবতে হয়নি। সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।”

তাই আজও শিক্ষক দিবসের আগে-পরে স্যরের কাছে ছুটে যান সে দিনের ছাত্র তন্ময়। নতুন রঙে পৃথিবীকে চেনার শুরুটা যে ওখান থেকেই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Krishna Nagar Education Academics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE