Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

নাবালিকার বিয়ে দিচ্ছেন না তো? অভিভাবক কড়া নজরে

মুর্শিদাবাদে এমন ঘটনা নিত্য দিনের!  কন্যাশ্রী যোদ্ধা, চাইল্ড লাইন, বেসরকারি সংগঠনের সদস্যদের পাশাপাশি সতর্ক রয়েছেন পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তারা। ফলে প্রায় প্রতিদিনই জেলার কোথাও না কোথাও নাবালিকার বিয়ে বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু তার পরেও বাল্যবিবাহের প্রবণতা বন্ধ করা যাচ্ছে না।

বিমান হাজরা
রঘুনাথগঞ্জ শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০১৮ ০১:৪২
Share: Save:

চুপিসাড়ে নাবালিকার পরিবার বিয়ের যাবতীয় আয়োজন করেছে। কোথাও বিয়ে উপলক্ষে চলছে খাওয়া-দাওয়া। বরপক্ষও এসে হাজির। এমন সময়ে পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজন গিয়ে বন্ধ করে দিলেন নাবালিকার বিয়ে।

মুর্শিদাবাদে এমন ঘটনা নিত্য দিনের! কন্যাশ্রী যোদ্ধা, চাইল্ড লাইন, বেসরকারি সংগঠনের সদস্যদের পাশাপাশি সতর্ক রয়েছেন পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তারা। ফলে প্রায় প্রতিদিনই জেলার কোথাও না কোথাও নাবালিকার বিয়ে বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু তার পরেও বাল্যবিবাহের প্রবণতা বন্ধ করা যাচ্ছে না।

প্রশাসন সূত্রে খবর, প্রথমে নাবালিকার বিয়ে বন্ধ করা হচ্ছে। তার পরে তাদের অনেককেই বািড় থেকে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে চুপিসাড়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ বার সেই প্রবণতা রুখতে নির্দিষ্ট কিছু গ্রাম বাছাই করে বেশ কিছু নাবালিকার পরিবার ও অভিভাবকদের উপরে নজরদারি শুরু করল একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। জেলার ২৬টি ব্লকেই বাল্য বিবাহ নিয়ে প্রশাসন ও পুলিশের সাহায্য নিয়ে কাজ করছে ওই সংস্থা।

রাজ্যের ১৯টি জেলার মধ্যে ইউনিসেফের তথ্য মতে সবথেকে বেশি কমবয়সে বিয়ের সংখ্যা মুর্শিদাবাদ জেলায় (প্রায় ৩৫.৮ শতাংশ)। প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হিসেবে, গত সাত মাসে বিভিন্ন ব্লকে অভিযান চালিয়ে জেলায় বাল্য বিবাহ বন্ধ করা গিয়েছে ২৫৩টি।

সংস্থার সহকারী অধিকর্তা জয়ন্ত চৌধুরী বলেন, “নাবালিকার বিয়ে বন্ধের পরে মুর্শিদাবাদে একটি বড় প্রবণতা হল মেয়েকে অন্যত্র নিয়ে গিয়ে গোপনে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। বিশেষ করে সুতি, শমসেরগঞ্জ ও ফরাক্কা এলাকায় এটা বেশি ঘটছে। ফলে বিয়ে বন্ধের সার্থকতা প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে। আবার জানাজানির আশঙ্কায় আগে থেকেই নাবালিকাকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই সম্ভাবনা দূর করতেই একটা নজরদারি ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। সবটাই করা হচ্ছে অত্যন্ত গোপনে। ওই সব পরিবারের অজান্তেই।”

সংস্থার হিসেবে, এই মুহূর্তে জেলার ২৬ টি ব্লকের ২৯০টি গ্রামের ১৬৬৯টি পরিবারকে নজরদারির আওতায় রাখা হয়েছে। জেলার মধ্যে নাবালিকা বিয়ের হার সবথেকে বেশি সুতি ও শমসেরগঞ্জে। সুতির দু’টি ব্লকে এ পর্যন্ত সাত মাসে বন্ধ করা গিয়েছে ৮৫টি বাল্যবিবাহ।

সংস্থার এক কর্তা বিজয় হাজরা বলছেন, “যেহেতু সুতি বিড়ি শ্রমিক অধ্যুষিত সংখ্যালঘু এলাকা, তাই এখানে কম বয়সে বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা চলে আসছে দীর্ঘ দিন ধরে। শিশু সুরক্ষা কমিটি, কন্যাশ্রীরা তো আছেই, তার পরে সুতির দু’টি পঞ্চায়েতে ৪০ জন করে বালিকা বধূকে নিয়ে বিশেষ কমিটিও গড়া হয়েছে। বালিকা বধূদের সকলেই কমবয়সে বিয়ে করে কী বিড়ম্বনার মধ্যে দিয়ে কাটিয়েছেন, তা বোঝাতেই তাদের প্রচারে নামানো হয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সুতি বাল্য বিবাহে এখনও জেলায় সর্বোচ্চ সারিতে। তাই ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সের কিশোরী রয়েছে এমন বাড়িগুলিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। সুতির দুই ব্লকে এই কিশোরীর সংখ্যা ২১৫। রেজিস্টারে নাম রাখা হয়েছে তাদের। প্রতি সপ্তাহে তাদের বাড়ি গিয়ে খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে তাদের না জানিয়েই। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ, গ্রামের কোনও ঘটনা ইত্যাদি নিয়ে কৌশলে জানার চেষ্টা হচ্ছে চিহ্নিত কিশোরী বাড়িতে রয়েছে কি না, তারা নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছে কি না ইত্যাদি বিষয়ে। এর মাধ্যমেই বোঝা যায় ওই পরিবারের মতিগতি। সেই মতই ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।”

নাবালিকা বিয়েতে পিছিয়ে নেই শমসেরগঞ্জও। এ পর্যন্ত ওই ব্লকে সাত মাসে বন্ধ হয়েছে ৬৭টি বাল্যবিবাহ। কিন্তু বন্ধ হওয়া বিয়েগুলি পরবর্তীতে ওই অবস্থায় রয়েছে কি না সে নজরদারি না থাকায় এ নিয়ে সংশয়ে ওই সংস্থারই শমসেরগঞ্জের কর্মী মীর আবু হেনা। তিনি বলছেন, “কাজ করতে গিয়ে দেখছি বিয়ে বন্ধ হওয়া কিশোরীদের অনেকেই বাড়িতে নেই। পাশেই ঝাড়খণ্ড। জিজ্ঞাসা করলেই উত্তর মিলছে ঝাড়খণ্ডে কুটুমবাড়ি বেড়াতে গিয়েছে। পরে তাদের বিয়ের খবর পেলেও তখন আর করার কিছু থাকছে না। তাই আগাম নজরদারির ব্যবস্থা। শমসেরগঞ্জে নজরদারির আওতায় রাখা হয়েছে ৮১ জন কিশোরীকে। গ্রামের শিশু সুরক্ষা কমিটি, কন্যাশ্রীরা তো নজর রাখছেই। পাশাপাশি নজর রয়েছে আমাদেরও। নিয়মিত বাড়িতে গিয়ে জেনে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে বিয়ে দেওয়ার কোনও কথাবার্তা চলছে কি না।”

ফরাক্কায় নজরদারির আওতায় রয়েছে ৭০ জন কিশোরী। সাগরদিঘিতেও ৭০টি পরিবারে নজর রাখা হচ্ছে। রঘুনাথগঞ্জের দু’টি ব্লকে নজরদারির আওতায় রয়েছে ১১৫ জন, হরিহরপাড়ায় ৮১ জন। জেলায় সব মিলিয়ে ১৬৬৯ পরিবার নজরদারির আওতায়। শমশেরগঞ্জের বিডিও জয়দীপ চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘দিনের দিন নাবালিকার বিয়ে বন্ধ করতে গিয়ে নানা সমস্যা ও অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হয়। নজরদারি বাড়িয়ে তা আগে থেকেই রুখে দেওয়া অনেক ভাল। সেই চেষ্টাই করা হচ্ছে।’’ এতে ফলও মিলতে শুরু করেছে বলে বিডিওর দাবি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Teenage Marriage Surveillance Police
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE