Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

শিক্ষা মিলেছে কলকাতার ভোটে, এ বার সতর্ক দুই জেলার পুলিশই

বাকি আর মোটে চারটে দিন। আগামী ২৫ এপ্রিল, নদিয়া-মুর্শিদাবাদের ১৪টি এলাকায় পুর-নির্বাচন রয়েছে। প্রশাসন সূত্রে খবর, তার আগে সোমবার রাত পর্যন্ত মুর্শিদাবাদের ৬টি পুরসভা মিলিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে মোট ৮২টি নির্বাচনী বিধিভঙ্গের অভিযোগ দায়ের হয়েছে। তার মধ্যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া লিখিত অভিযোগের সংখ্যা প্রায় ৭০টি।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৫ ০১:৩৫
Share: Save:

বাকি আর মোটে চারটে দিন। আগামী ২৫ এপ্রিল, নদিয়া-মুর্শিদাবাদের ১৪টি এলাকায় পুর-নির্বাচন রয়েছে। প্রশাসন সূত্রে খবর, তার আগে সোমবার রাত পর্যন্ত মুর্শিদাবাদের ৬টি পুরসভা মিলিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে মোট ৮২টি নির্বাচনী বিধিভঙ্গের অভিযোগ দায়ের হয়েছে। তার মধ্যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া লিখিত অভিযোগের সংখ্যা প্রায় ৭০টি।

বহু অভিযোগ জমা পড়েছে নদিয়াতেও। নদিয়া পুলিশ বিভিন্ন প্রান্তে বিশেষ অভিযান চালিয়ে এখনও পর্যন্ত ৪২৭ জনকে সর্তকতামূলক গ্রেফতার করেছে। সোমবার অবধি বিভিন্ন মামলায় অধরা ৮৫ জনকে তড়িঘড়ি গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। এ ছাড়াও নদিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে ১০টি আগ্নেয়াস্ত্র, ১৪টি গুলি ও ৪৪টি বোমা উদ্ধার হয়েছে। মুর্শিদাবাদ জেলা পুলিশ এখনও পর্যন্ত সর্তকতামূলক গ্রেফতারের অঙ্গ হিসেবে ১৫০ জনকে ধরেছে।

পুলিশ ও প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ভোটের আগে শান্তি বজায় রাখতেই এই তৎপরতা। তবে প্রশাসনের অন্দরের একটি সূত্র জানাচ্ছে, কলকাতার পুরভোটের দিনে শেষবেলায় আক্রান্ত হয়েছিল খোদ পুলিশ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নদিয়া জেলা পুলিশের এক কর্মী বলছেন, ‘‘শাসক দলের কথা মতো কাজ করার পরেও কলকাতায় কী হল তা তো চোখের সামনে দেখলাম। পুরস্কার মিলল বুলেট।’’

পুলিশের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা এই প্রথম নয়। আইনরক্ষকদের আক্রান্ত হওয়ার বহু নজির রয়েেছ। শাসক দলের তাণ্ডবের হাত থেকে রেহাই পেতে আলিপুরে ফাইল মাথায় দিয়ে টেবিলের তলায় পুলিশের সেঁধিয়ে যাওয়ার সেই দৃশ্য এখনও ফিকে হয়নি। সেই শুরু, তারপর থেকে একের পর এক ঘটনায় পুলিশের আক্রান্ত হওয়ায় ক্ষোভ বেড়েছে পুলিশের নীচুতলার কর্মীদের। পুলিশের পক্ষপাতিত্বের ফলে কলকাতার পুরভোট কতটা অবাধ হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরা। কেন কলকাতায় আগে থেকে সর্তকতামূলক গ্রেফতার করা হয়নি, উঠেছে সেই প্রশ্নও। সেই সব নানা ঘটনা থেকে ‘শিক্ষা’ নিয়ে দুই জেলায় পুলিশের আগাম এই ‘সক্রিয়তা’ বলে রাজনৈতিক মহলের মত।

বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি অবশ্য পুলিশের সক্রিয়তা মানতে রাজি নয়। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘শুধু বিরোধীদের ক্ষেত্রে তদন্ত করে পুলিশ মামলা দায়ের করছে। কিন্তু, শাসকদলের নেতাকর্মীরা অভিযুক্ত হয়েও বুক ফুলিয়ে প্রকাশ্য সভায় দাঁড়িয়ে মাইকে বক্তব্য রাখছেন, মিছিলেও হাঁটছেন।’ মুর্শিদাবাদের পুরসভাগুলি ভোটে অশান্তির আশঙ্কা করছেন জেলা সিপিএমের সম্পাদক মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য। জেলা কংগ্রেসের মুখপাত্র অশোক দাসের প্রশ্ন, “যেখানে পুলিশ শাসকদলের হয়ে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি ও ভয় দেখায়, সেখানে শান্তিতে ভোট হবে কী করে?” তাঁর অভিযোগ, কান্দি পুরসভা এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে রাতের অন্ধকারে পুলিশ গিয়ে ভয় দেখাচ্ছে। পুলিশের বিরুদ্ধেই জেলা নির্বাচনী আধিকারিকের কাছে চারটি লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে।

প্রচারে বের হলে গত ১৩ এপ্রিল জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ পুরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম মনোনীত নির্দল প্রার্থী তথা বিদায়ী পুরপ্রধান শঙ্কর মণ্ডলকে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা হুমকি দেয় বলে অভিযোগ। নির্বাচন কমিশনের কাছে লিখিত ভাবে বিযয়টি জানিয়েছিলেন শঙ্করবাবু। ব্লক মডেল কোড কন্ডাক্ট দল তদন্ত করে পদক্ষেপ করার নির্দেশ দেয় পুলিশকে। অভিযোগ, জিয়াগঞ্জ থানার পুলিশ এখনও পর্যন্ত অভিযুক্ত তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। শঙ্করবাবুর অভিযোগ, “পুলিশ প্রশাসনের মদতে তৃণমূলের নেতারা এখনও বিভিন্ন ওয়ার্ডে দলীয় প্রার্থীদের হুমকি দিচ্ছে। আগের অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযুক্তদের ধরা তো দূর, ঘটনায় পুলিশ এখনও তদন্তে আসার সময় পায়নি!”

মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার সি সুধাকরের অবশ্য দাবি, “নির্বাচন বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ পেলেই তদন্ত করে সুনির্দিষ্ট ধারায় মামলা করা হয়েছে।’’ শাসক দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশ কোনও পদক্ষেপ না করায় ফুঁসছে নিচুতলার পুলিশ কর্মীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মী বলেন, ‘‘একেবারে শাখের করাতের অবস্থা! এক দিকে শাসক দলের নেতা-কর্মীদের চোখ রাঙানি হজম করতে হচ্ছে, অন্য দিকে তাঁদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করতে গেলে উপরতলার পুলিশ অফিসারদের বকাঝকা খেতে হচ্ছে। ভোটের দিন যে কী হবে!’’ বিরোধীদের অভিযোগ উড়িয়ে জেলা তৃণমূলের সভাপতি মান্নান হোসেনের দাবি, “পুরভোটে কংগ্রেস-সিপিএম-বিজেপি ভাই ভাই হয়েছে। এখন তারা এক জোট হয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ করছে।’’

তবে, শান্তিপূর্ণ ভোট করানোর ভার যাদের কাঁধে, সেই পুলিশ কর্মীদের বিরুদ্ধেই কান্দি থানায় চারটে অভিযোগ জমা পড়েছে। সবগুলিই ভোটারদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে হুমকি ও ভয় দেখানোর জন্য। পুরভোটের মুখে মুর্শিদাবাদ ও জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ পুরসভায় এখন পর্যন্ত মোট পাঁচটি লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে বলে জানা গিয়েছে। তার মধ্যে চারটি জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ পুরসভায় এবং একটি মুর্শিদাবাদ পুরসভায়। জিয়াগঞ্জ পুরসভায় যে চারটি অভিযোগ জমা পড়েছে তার মধ্যে কংগ্রেস, সিপিএমের বিরুদ্ধে একটি করে এবং দু’টি অভিযোগ রয়েছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে।

পাশের জেলা নদিয়ায় ৮টি পুরসভায় ভোট হচ্ছে৷ তার মধ্যে গয়েশপুরে ইতিমধ্যেই পুরবোর্ডের ‘দখল’ নিয়েছে তৃণমূল। অন্য পুরসভাগুলিও গায়ের জোরে তৃণমূল দখলে নিতে চাইছে বলে অভিযোগ। নদিয়ার জেলাশাসক পিবি সালিম জানান, দফতরে গা-জোয়ারি ও আদর্শ নির্বাচনী বিধিভঙ্গের তিনটি অভিযোগ জমা পড়েছে।

পয়লা এপ্রিল বিজেপির তরফে জেলাশাসকের কাছে অভিযোগ করা হয়, বীরনগরের পুরপ্রধান তৃণমূলের পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও উপপুরপ্রধান স্বপন দাস বিধি ভেঙে বার্ধক্য ভাতার ‘টোকেন’ বিলি করছেন৷ ১৯ এপ্রিল নবদ্বীপ পুরসভার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী গোপীনাথ প্রসাদ অধিকারী ভোটের আগের দিন কেদারপাড়া ও গোবিপাড়া এলাকায় ভোটারদের প্রলুব্ধ করার জন্য টাকা-পয়সা দেওয়ার আশঙ্কা করে জেলাশাসকের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন৷ ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণার দিন কয়েক পরে বিজেপি নবদ্বীপের কয়েক’টি বুথে শাসকদল ঝামেলা পাকাতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে জেলাশাসককে চিঠিও দেয়৷

এ ছাড়াও নবদ্বীপ পুরভোটকে কেন্দ্র করে কৃষ্ণনগর সদর মহকুমাশাককের কাছেও বিজেপি ও সিপিএম দু’টি করে অভিযোগ করেছে। ৭ এপ্রিল বিজেপির তরফে করা অভিযোগে দাবি করা হয়, ভোট বিধি ভেঙে নবদ্বীপ শহরজুড়ে নতুন রাস্তা-ঘাট বানানো হচ্ছে। ১৬ এপ্রিল বিজেপির তরফে অভিযোগে বলা হয়, তাদের মাইক বাজানোর অনুমতি দেওয়া হয়নি। কিন্তু ১৮ এপ্রিল শুভেন্দু অধিকারীর সভার জন্য মাইকে প্রচার চলছে।

কল্যাণীর মহকুমাশাসকের কাছে ভোট সংক্রান্ত সাতটি অভিযোগ জমা পড়েছে। তার মধ্যে ছ’টি অভিযোগই শাসকদলের বিরুদ্ধে। পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলেও অভিযোগ। কল্যাণী থানার এক পুলিশকর্মী বলেন, ‘‘শাসকদলের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্য উপরমহলের নির্দেশ রয়েছে। ইচ্ছা থাকলেও কিছু করতে পারছি কই?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE