বলদেব মন্দির
রাত তখন সোয়া এগারোটা। সুনসান মন্দিরের মূল ফটকে তালা দিতে গিয়ে চমকে উঠেছিলেন বলদেব মন্দিরের কিশোরকৃষ্ণ গোস্বামী। ফটকের বাইরে দু’জন লোক দাঁড়িয়ে আছে যেন!
এত রাতে মন্দিরের গেটে লোক কেন? বুকটা ছ্যাঁত করে উঠেছিল তাঁর। মন্দিরের ফটক থেকে কিছু দূরে মোড়ের মাথায় পথবাতির আলো তেরছা হয়ে মন্দিরের গেটে পড়েছে। ঝিরঝিরে বৃষ্টির সঙ্গে সোডিয়াম ভেপারের ফ্যাকাশে আলোয় চার দিকটা কেমন যেন ঝাপসা। তার ভিতর দিয়ে ভাল করে নজর চলে না। কিন্তু দু’জন মানুষের হাঁটাচলা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
—“কে ওখানে? কি চাই?” একটু জোরের সঙ্গে হেঁকে ওঠেন গোঁসাই। সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা উত্তর আসে, “আমরা পুলিশের লোক।”
কিশোরকৃষ্ণের এ বার বিস্মিত হওয়ার পালা। এত রাতে পুলিশ কেন? চাবি হাতে এগিয়ে যান ফটকের কাছে। গিয়ে দেখেন সত্যিই বন্দুক ঘাড়ে দু’জন পুলিশ দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কথা বলে জানতে পারেন অগস্টের গোড়া থেকেই নবদ্বীপের বিভিন্ন মঠমন্দিরের সামনে প্রতি দিন রাতে শুরু হয়েছে সশস্ত্র পুলিশের নৈশপাহারা। রাত দশটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত পায়ে হেঁটে নবদ্বীপের বিভিন্ন মঠমন্দিরের উপর নজরদারির এই কাজ শুরু হয়েছে খোদ জেলা পুলিশ সুপারের নির্দেশে। তবে কি এত দিনে টনক নড়ল পুলিশের?
নবদ্বীপের মঠমন্দিরে বিভিন্ন সময়ে মূর্তি-সহ মূল্যবান অলঙ্কার ও নানা জিনিস চুরি যাওয়া নতুন কিছু নয়। কখনও খোয়া যাওয়া বিগ্রহ বা অন্যান্য জিনিস উদ্ধার হয়েছে, কখনও হয়নি। কোনও মন্দিরে চুরির ঘটনা ঘটলেই নবদ্বীপের মঠমন্দির প্রধানেরা শহরের মন্দিরগুলির সামনে রাতে পুলিশি নজরদারির দাবি তুলতেন। বিশেষ করে শীত এবং বর্ষার রাতে। সাময়িক ভাবে তখন কিছু দিন পুলিশের রাতটহলের গাড়ি একবার করে চক্কর মেরে যেত একেবারে উত্তরে প্রাচীনমায়াপুরের জন্মস্থান আশ্রম থেকে দক্ষিণপ্রান্তের কোলেরডাঙা মঠ পর্যন্ত। কিছু দিন পর ধীরে ধীরে আবার তা বন্ধও হয়ে যেত।
কিন্তু এ বার ব্যাপারটা ঠিক তেমন নয়। শুধুমাত্র নবদ্বীপের মঠ-মন্দিরের জন্য আলাদা ভাবে ওই সশস্ত্র রাত পাহারার ব্যবস্থা হয়েছে। পুলিশের পরিভাষায় যার নাম ‘ফুট পেট্রোলিং’। জানা গিয়েছে নবদ্বীপ শহরের মঠমন্দির এলাকাগুলিকে কয়েকটি ‘জোনে’ ভাগ করে এই রাত পাহারার বন্দোবস্ত করা হয়েছে।
শহরের কেন্দ্রস্থলে পোড়ামাতলা, মহাপ্রভুপাড়া, যোগনাথতলা, গানতলা ব্রজানন্দ গোস্বামী রোড নিয়ে তেমনই একটি অঞ্চল। এখানে রয়েছে পোড়ামা মন্দির, ভবতারিণী, মহাপ্রভু মন্দির, বলদেব মন্দির, গোবিন্দমন্দির, মদনমোহন মন্দিরের মতো একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্দির। এই অঞ্চলেই রয়েছে মহাপ্রভুর পাদুকা এবং বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর স্বহস্তে সেবিত মহাপ্রভু বিগ্রহ।
নবদ্বীপ গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের সহ-সভাপতি কিশোরকৃষ্ণ গোস্বামী জানিয়েছেন “অত্যন্ত সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। আমরা বহু দিন ধরে এটাই চাইছিলাম। শুধু এই সিকি মাইলের মধ্যেই রয়েছে ২৭টি গুরুত্বপূর্ণ মঠমন্দির। ফলে এই এলাকার উপর দুষ্কৃতীদের সবসময় আলাদা নজর থাকে। প্রাচীন বিগ্রহ খোয়া গেলে অপূরণীয় ক্ষতি হয়।”
অন্য দিকে, সনাতন সন্ত সমাজের সভাপতি অদ্বৈত দাস বলেন, “নবদ্বীপ শহর এখন পর্যটকদের উপর নির্ভরশীল। যত দিন যাচ্ছে বহিরাগত মানুষের সংখ্যা তত বাড়ছে। সেই সঙ্গে মন্দিরে মন্দিরে বাড়ছে অবাঞ্ছিত মানুষের ভিড়ও। অনেকেই নিছক মন্দির দেখতে আসেন না। এই সব ক্ষেত্রে মঠমন্দির কর্তৃপক্ষের নজরদারিতে কাজ হয় না। দরকার ছিল নিয়মিত পুলিশি নজরদারি। এটা চালু হওয়াতে আমরা কিছুটা নিশ্চিন্ত হলাম।”
সারা নবদ্বীপ শহরে কমবেশি দেড়শো মঠমন্দির আছে। এগুলি প্রধানত চারটি অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত। শহরের কেন্দ্রস্থলের অঞ্চলটি ছাড়াও গঙ্গার তীর সংলগ্ন শ্রীবাসঅঙ্গন রোড অঞ্চলে রয়েছে সোনার গৌর, রাধারমণ বাগ সমাজবাড়ি-সহ গোটা পনেরো মন্দির। একেবারে দক্ষিণে দেবানন্দ গৌড়ীয় মঠ, মহানির্বান মঠ, মণিপুর রাজবাড়ি, রানির বাড়ি, সারস্বত গৌড়ীয় মঠ, কেশবজী গৌড়ীয় মঠ-সহ কমবেশি গোটা কুড়ি মন্দির। শহরের একেবারে উত্তরে প্রাচীন মায়াপুরে রয়েছে খোদ চৈতন্য জন্মস্থান আশ্রম-সহ তিরিশটিরও বেশি মন্দির।
পুলিশি নজরদারির পাশাপাশি নবদ্বীপের বিভিন্ন মঠমন্দিরে বিগ্রহ এবং অনান্য মূল্যবান সামগ্রীর ধারাবাহিক চুরি ঠেকাতে ইতিমধ্যে মন্দিরে সিসিটিভি বসাতে শুরু করেছেন। নবদ্বীপে বলদেব মন্দিরে প্রথম সিসিটিভি বসানো হয় গত মে মাসে। বসানো হয়েছে আটটি ক্যামেরা। এরপর যান্ত্রিক নজরদারি শুরু হয় গোবিন্দ মন্দিরে। দিন কয়েক আগে নবদ্বীপের রাধামদনমোহন মন্দিরের গর্ভগৃহ, নাটমন্দির-সহ পুরো মন্দির মুড়ে ফেলা হয়েছে আটটি ক্যামেরা দিয়ে। প্রাচীনমায়াপুরের জন্মস্থান আশ্রমেও বসেছে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। রাধারমণ বাগ সমাজবাড়ির মতো বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী মন্দিরেও সিসিটিভি বসানোর প্রস্তুতি চলেছে। ধামেশ্বর মহাপ্রভু মন্দিরের পরিচালন সমিতির পক্ষে পুলক গোস্বামী জানিয়েছেন, “এখন মন্দিরে সংস্কারের কাজ চলছে। কাজ শেষ হলেই মন্দিরের নিরাপত্তায় আমরাও সিসিটিভি বসাবো।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy