Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

বাড়ির কেউ হলে করতেন?

কৃষ্ণনগর কালেক্টরি মোড়ের কাছে রাস্তা জুড়ে চলছে বিজেপির সভা। সোমবার, মঞ্চে দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। হুটার বাজিয়ে এসে পৌঁছল অ্যাম্বুল্যান্স। ভিতরে ছটফট করছেন আসন্নপ্রসবা। কিন্তু মঞ্চ থেকে দিলীপ হুঙ্কার দিলেন, ‘‘এখান দিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। ঘুরিয়ে অন্য দিক দিয়ে নিয়ে যান।’’ বুধবার আবার তিনি দাবি করেন, ‘‘ওই অ্যাম্বুল্যান্সে চালক ছাড়া কেউ ছিল না।’’ দেখল-শুনল আনন্দবাজার। কথাটা শুনেই মনে-মনে আল্লাকে ডাকতে থাকি। এক-একটা মুহূর্ত যেন আর কাটতে চাইছিল না।

বিজেপির সভার পাশে আটকে পড়া সেই অ্যাম্বুল্যান্স। ফাইল চিত্র

বিজেপির সভার পাশে আটকে পড়া সেই অ্যাম্বুল্যান্স। ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২০ ০১:০৭
Share: Save:

অসহ্য যন্ত্রণা পেটে। সহ্য করতে পারছিলাম না। খালি ভাবছি, কখন হাসপাতালে পৌঁছব।

হঠাৎ টের পেলাম, কারা যেন অ্যাম্বুল্যান্স আটকে দিয়েছে। চালক বারবার অনুরোধ করছেন রাস্তা ছেড়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু উল্টো দিকের লোকেরা রাজি হচ্ছে না। এর মধ্যেই কানে এল, মাইকে কে যেন বলছে অ্যাম্বুল্যান্স যেতে দেওয়া হবে না। ঘুরে অন্য দিক দিয়ে যেতে হবে।

কথাটা শুনেই মনে-মনে আল্লাকে ডাকতে থাকি। এক-একটা মুহূর্ত যেন আর কাটতে চাইছিল না। শুধু মনে হচ্ছিল, পেটের সন্তানকে সুস্থ ভাবে পৃথিবীর আলো দেখাতে পারব কি না। খুব অসহায় লাগছিল। ভাবছিলাম, যে মাইকে ঘুরপথে যাওয়ার কথা বলছে, তার বাড়িতেও হয়তো মা-বোন আছে। তাদের কারও যদি এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হত, কী করতেন? মিটিংয়ে যে মহিলারা আছেন, তাঁরাও তো কারও মা-বোন। তাঁরা কেন এগিয়ে এসে রাস্তা করে দিচ্ছেন না?

প্রচণ্ড যন্ত্রণার মধ্যে এক বার চোখ খুলে দেখি, মা কাঁদছে। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বাইরের লোকজনকে অনুরোধ করছে রাস্তা ছাড়তে। কিন্তু লোকগুলো শুনছে না। শেষে চালক অ্যাম্বুল্যান্স ঘোরালেন। যারা অ্যাম্বুল্যান্স আটকালেন, তাঁদের কাছে অনুরোধ, এই কাজ আর করবেন না।

পাপিয়া বিবি

অ্যাম্বুল্যান্সে থাকা প্রসূতি

এক মিনিটের রাস্তা

ধুবুলিয়া গ্রামীণ হাসপাতাল থেকে জেলা সদর হাসপাতালে যাচ্ছি। প্রায় প্রতিদিনই যাই। কিন্তু গাড়িতে একটা মেয়ে প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করছে।

কৃষ্ণনগর ঢুকে কালেক্টরি মোড়ে পৌঁছে দেখি, রাস্তায় জমায়েত। এক পাশে মঞ্চ করে বিজেপি সভা করছে। আমার বিশ্বাস ছিল, অ্যাম্বুল্যান্স কেউ আটকাবে না। রাস্তা করে দেবে। কিন্তু ওরা রাস্তা আটকে দিল। মাত্র মিনিট খানেকের পথ সদর হাসপাতাল। কিছু লোক সরে দাঁড়ালেই আমরা বেরিয়ে যেতে পারি। কিন্তু উল্টে শুনি, মঞ্চ থেকে নেতা ধমকে বলছেন অন্য রাস্তা দিয়ে যেতে। আমি লোকজনকে বলতে থাকি, অ্যাম্বুল্যান্সে প্রসূতি আছে। তার অবস্থা ভাল না। কিন্তু আমার কথা কে শুনবে? উল্টে মাইকে নেতা বলার সঙ্গে-সঙ্গে রিছু লোক গাড়িটা পিছনের দিকে ঠেলতে থাকে। বাধ্য হয়ে আমি অ্যাম্বুল্যান্স ঘুরিয়ে নিই। কৃষ্ণনগর শহরের রাস্তা বিশেষ চেনা নেই। পথচলতি লোকেদের জিজ্ঞাসা করে এগোচ্ছি। কিছুটা গিয়ে দেখি, রাস্তায় গর্ত করে মাটির তলা দিয়ে বিদ্যুতের কেবল পাতা হচ্ছে। বাধ্য হয়ে আবার অ্যাম্বুল্যান্স ঘুরিয়ে নেই। একটু বাদেই, সামনে আবার তৃণমূলের মিছিল। বুকের মধ্যে ধড়াস করে ওঠে। কিন্তু এ বার উল্টো ঘটনা ঘটল। মিছিলের লোকরা সরে দাঁড়িয়ে রাস্তা করে দিল। শেষে জেলা সদর হাসপাতালে পৌঁছালাম। এক মিনিটের রাস্তা ঘুরে আসতে সময় লেগে গেল প্রায় ২৫ মিনিট। প্রায় দু’বছর ধরে অ্যাম্বুল্যান্স চালাচ্ছি। কখনও এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি।

রথীন্দ্রনাথ বিশ্বাস

অ্যাম্বুল্যান্স চালক

সাধারণ বোধটুকু থাকে না?

অ্যাম্বুল্যান্সের মধ্যে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে মেয়েটা। শুধু ভাবছি, হাসপাতালে কতক্ষণে পৌঁছব। কৃষ্ণনগর শহরে ঢোকার পরে মনে হল, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। চালক বললেন, আর মিনিট দুয়েকের মধ্যে পৌঁছে যাব। কিন্তু এ কী! কিছু দূর যেতেই দেখি, বিজেপির মিটিং হচ্ছে। রাস্তা জুড়ে লোকে বসে। অ্যাম্বুল্যান্স দেখেও তারা কিছুতেই উঠল না। বরং মিটিংয়ের কিছু লোক এসে অ্যাম্বুল্যান্সটাকে পিছনে ঠেলছিল। শুনতে পাচ্ছি, তখন মাইকে এক নেতা বলছেন, আমাদের যেতে দেওয়া হবে না। অ্যাম্বুল্যান্স ঘুরিয়ে নিতে হবে। মেয়েটা তখন যন্ত্রণায় পাগলের মতো ছটফট করছে। পেটের বাচ্চাটা কেমন আছে, বুঝতে পারছি না। মেয়েটার কী হবে, ভেবে পাচ্ছি না। জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে সবাইকে হাতজোড় করে অনুরোধ করছি, আমাদের যেতে দিন! চালকও বারবার অনুরোধ করছেন। কিন্তু ওরা কেউ আমাদের কথা কানেই তুলল না। উল্টে শুনছি, মঞ্চ থেকে মাইকে বলছে, আমরা নাকি গন্ডগোল পাকানোর জন্য এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। ভাবুন এক বার! বাধ্য হয়ে চালককে বললাম, ঘুরিয়ে নিন। ভয় হচ্ছিল, যদি গাড়ি ভাঙচুর করে, মেয়েটার কী হবে? গাড়ি ঘুরিয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময়ে আবার দেখি সামনে তৃণমূলের মিছিল। তবে ওরা রাস্তা ছেড়ে দিল। সবার কেন সাধারণ বোধটুকু থাকে না?

সাহিনুর মিস্ত্রি

প্রসূতির মা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dilip Ghosh Ambulance
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE