Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

তুর্কিনাচন নাচাচ্ছে জ্যোতি আর চন্দ্রমুখী

উল্টো দিকে ব্যাগ হাতে দাঁড়ানো খরিদ্দারদের মুখে কথা নেই। এক জন ডালা থেকে একটা ফ্যাকাসে চন্দ্রমুখী তুলে পরখ করে বললেন, “এই আলু তো তেমন ভাল নয়। কিছু কমটম করে যদি...।”

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০২০ ০১:৩১
Share: Save:

একেবারে আম্পায়ার ডিকি বার্ডের কায়দায় তর্জনী উঁচিয়ে আলুর দাম জানাচ্ছিলেন তিনি। সামনে নানা রকম আলুর ডালা। চন্দ্রমুখী ৩৫, জ্যোতি ৩০, নতুন আলু ২৫ টাকা।

উল্টো দিকে ব্যাগ হাতে দাঁড়ানো খরিদ্দারদের মুখে কথা নেই। এক জন ডালা থেকে একটা ফ্যাকাসে চন্দ্রমুখী তুলে পরখ করে বললেন, “এই আলু তো তেমন ভাল নয়। কিছু কমটম করে যদি...।” তাঁকে কথা শেষ করতে না দিয়ে দোকানি অনিমেষ দে বলে উঠলেন, “ওই যা ডালায় দেখছেন, আজকের পর কাল থেকে ওইটুকুও পাবেন না। চন্দ্রমুখী শেষ। জ্যোতির যা দর হাঁকছে, তাতে পড়তায় পোষাবে না। শুধু নতুন আলু বেচব। মাসখানেক যাক, তার পরে দেখা যাবে।”

গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকেই তরতরিয়ে বেড়ে চলেছে আলুর দাম। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এসেও তা কমার কোনও লক্ষণ নেই। উল্টো আলুর জোগান কমতে শুরু করেছে। চন্দ্রমুখী বা জ্যোতির মতো বহুল প্রচলিত আলু মিলছে না। বিক্রেতারা জানাচ্ছেন, মজুতের পরিমাণ ফুরিয়ে আসায় সদ্য ওঠা নতুন আলুই এখন ভরসা। কিন্তু অন্য বার যখন এই সময়ে ১০-১২ টাকা কেজিতে নতুন আলু বিক্রি হয়, তা এই মুহূর্তে ২৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে জেলার প্রায় সর্বত্র। প্রথমে পেঁয়াজ, তার পরে আলু— এই দুই নিত্যপ্রয়োজনীয় আনাজের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধির জেরে দিশেহারা সাধারণ মানুষ।

শেষ ডিসেম্বরের বাজারে আলুর দর যা ছিল, জানুয়ারির প্রথমে এসে তা কমার বদলে আরও বেড়েছে। দু’সপ্তাহের দিনের ব্যবধানে খুচরো বাজারে প্রতি কেজি আলুর দরের বৃদ্ধির চেহারা অনেকটা এই রকম— জ্যোতি ২২-২৩ টাকা থেকে বেড়ে ৩০ টাকা, চন্দ্রমুখী ৩২ টাকা থেকে বেড়ে ৩৫ টাকা। নতুন আলুর দর অবশ্য অল্প হলেও কমেছে। গত ডিসেম্বরে ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া পোখরাজ প্রজাতির নতুন আলু এখন ২৫ টাকা দরে মিলছে। সে আলুর গুণগত মান বিশেষ ভাল নয়। কিন্তু আলু চাষি থেকে বিক্রেতা সকলেই জানাচ্ছেন, আপাতত মাসখানেক এই আলুনি আলুই ভরসা বাঙালির।

শীতের সময় প্রচুর শাকসব্জি পাওয়া যায়, নানা রকম আনাজ সস্তায় মেলে বলে লোকে বছরভর এই দুটো মাসের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু এই শীত অল্প টাকায় বাজার করার সুখ কপালে নেই। ঘোরতর শীতেও আলু আর পেঁয়াজ কালঘাম ছুটিয়ে দিচ্ছে বাঙালির। অনেক আনাজও বিক্রি হচ্ছে প্রায় তিন গুণ বেশি দামে। সব বাদ দিয়ে খালি আলুসেদ্ধ ভাত খেয়ে চালাবেন, সেই রাস্তাও বন্ধ।

কেন এই অবস্থা?

আলু ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রধান কারণ মজুত আলু ফুরিয়ে যাওয়া এবং নতুন আলু সময় মতো বাজারে না আসা। নবদ্বীপের ব্যবসায়ী অনিমেষ দে-র কথায়, “ডিসেম্বরের ৩১ তারিখে আলুর হিমঘর বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ যাবতীয় মজুত আলু শেষ। অন্য বার এই সময়ে নতুন আলু উঠে যায়। ফলে অসুবিধা হয় না। কিন্তু এ বার খারাপ আবহাওয়ার জন্য চাষে অনেক দেরি হয়েছে। তাই বাজারে নতুন আলু আসতেও দেরি হচ্ছে। সেই কারণেই দাম এমন লাগামছাড়া।”

চাষিরা জানাচ্ছেন, আলু চাষের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে এ বার পরপর বৃষ্টি হওয়ায় চাষে দেরি হয়েছে। রাজ্যের এক কৃষিকর্তা পার্থ ঘোষ বলেন, “এই সময়ে হিমঘরগুলি বন্ধ হয়ে যায়। কেননা মজুত আলু শেষ হয়ে যায়। ফাঁকা হিমঘর ঝাড়পোঁছ, জীবাণুমুক্ত করা হয় পরের মরসুমের আলুর জন্য। ঠিক এই সময়েই নতুন আলু বাজারে এসে যায়।’’ তাঁর মতে, সব ফসলের উৎপাদন ও বিপণনের একটা হিসেব আছে। যেমন কার্তিকে বোনা শীতের আলু মাঘ-ফাল্গুনে তোলা হয়। জলদি জাতের আলু পৌষেই বাজারে চলে আসে। ফলে মজুত ফুরিয়ে গেলেও বিরাট কিছু অসুবিধা হয় না। কিন্তু এ বার প্রাকৃতিক দুর্যোগে ছল ওলটপালট হয়ে গিয়েছে।

আলুর পাইকার নিমাই মণ্ডল অবশ্য দাবি করছেন, আলুর দাম দ্রুত কমবে। তিনি বলেন, “মজুত ফুরিয়ে যায় বলে চন্দ্রমুখী বা জ্যোতি এই সময়ে কিছু দিন পাওয়া যায় না। এটা নতুন কিছু নয়। আসলে পঞ্জাবের আলু কম আসছে। সেই সুযোগে বেশি দরে আলু বিক্রি শুরু হয়েছে। এটা খুব তাড়াতাড়ি কমতে শুরু করবে। নতুন আলুও আসতে শুরু করেছে।”

যদিও বাজারে আসা নতুন আলু এখনও তেমন প্রমাণ সাইজের হচ্ছে না। চাষিরা জানাচ্ছেন, সাধারণত গড়ে ৬০ দিন লাগে আলু তৈরি হতে। এ বার চাষে দেরির কারণে বাজারে এখন যে আলু আসছে, সেই পোখরাজের বয়স বড় জোর ৪০ দিন। আরও সপ্তাহ তিনেক লাগবে পরিণত আলু আসতে। তারও পরে চাঁপাডাঙার আলু উঠবে। তত দিন কি আলুর বাজার এই একই রকম চড়া থাকবে?

সেটাই এখন ৩৫ টাকার প্রশ্ন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Potato Price Hike Bazar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE