Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

সরকারি বরাদ্দের প্রতীক্ষায় রায়বাহাদুরের সংগ্রহশালা

পাঁচ-পাঁচটা সরকার পাল্টেছে। কংগ্রেস, যুক্তফ্রন্ট, ফের কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের অবসানের পর গত চার বছর ধরে রাজ্যে ক্ষমতায় রয়েছে তৃণমূল সরকার। বিগত সাড়ে পাঁচ দশক ধরে জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জের ভাগীরথী দিয়ে জলও গড়িয়েছে বহু। এর পরেও জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জের নেহালিয়ার রাজা রায়বাহাদুর সুরেন্দ্রনারায়ণ সিংহের স্বপ্ন আজও পূরণ হয়নি।

জায়গার অভাবে এ ভাবেই পড়ে রয়েছে প্রত্নসামগ্রী। গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।

জায়গার অভাবে এ ভাবেই পড়ে রয়েছে প্রত্নসামগ্রী। গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।

অনল আবেদিন
জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ শেষ আপডেট: ২০ মে ২০১৫ ০১:২৯
Share: Save:

পাঁচ-পাঁচটা সরকার পাল্টেছে।

কংগ্রেস, যুক্তফ্রন্ট, ফের কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের অবসানের পর গত চার বছর ধরে রাজ্যে ক্ষমতায় রয়েছে তৃণমূল সরকার। বিগত সাড়ে পাঁচ দশক ধরে জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জের ভাগীরথী দিয়ে জলও গড়িয়েছে বহু। এর পরেও জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জের নেহালিয়ার রাজা রায়বাহাদুর সুরেন্দ্রনারায়ণ সিংহের স্বপ্ন আজও পূরণ হয়নি।

মুর্শিদাবাদ জেলায় পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ হতে পারত যে সংগ্রহশালা, তা নিজেই অবহেলিত। মাঠঘাট থেকে ‘প্রত্নপাগল’ রাজার সংগ্রহ করা হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলমান আমলের বহু প্রত্ন-ইতিহাস লোপাট হয়ে গিয়েছে। সংস্কার ও সংরক্ষণের জন্য বরাদ্দ সরকারি টাকা খরচ না হয়ে ফিরে গিয়েছে।

সংগ্রহশালা গড়তে ১৯৬০ সালে জমি, প্রস্তরমূর্তির বিপুল সম্ভার ও ব্যক্তিগত সংগ্রহের সমৃদ্ধশালী গ্রন্থাগার সরকারকে দান করেছিলেন রায়বাহাদুর। নেহালিয়ার রাজবাড়ির শ’খানেক মিটার সামনে ৩৬ শতক জমি দান করেছিলেন সুরেন্দ্রনারায়ণ। সেই জমিতে একতলা তিন কামরার ‘মুর্শিদাবাদ জেলা সংগ্রহশালা’ গড়তে ১৯৬০ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত পাক্কা ৩৭ বছর গড়িয়ে গিয়েছে। ২০০৭-এর অক্টোবরে অসম্পূর্ণ সংগ্রশালা দর্শকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। ঘরের অভাবে সেখানে আজও অনেক প্রত্ন-নিদর্শন গাদা করে ফেলে রাখা হয়েছে। রাজার দান করা দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ নিয়ে গ্রন্থাগারও গড়ে ওঠেনি। জমি ও অর্থের অভাব নেই। অভাব কেবল সরকারি উদ্যোগের। সংগ্রহশালা সূত্রের দাবি,। সেখানে শুধু নবম-দশম শতকের প্রত্ন নিদর্শন নয়, খ্রিস্টের জন্মের ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার বছর আগের অর্থাৎ ক্ষুদ্রাশ্মীয় সংস্কৃতির নিদর্শনও রয়েছে। সংগ্রহশালার কিউরেটর মৌসুমি বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, ‘‘দফতর থেকে প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। টাকাও বরাদ্দ হয়েছে। সংগ্রহশালাটি দোতলা ও তিনতলা করার পরিকল্পনা রয়েছে। পিছন দিকে ঘর তুলে অফিস সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। প্রত্ন প্রদর্শনের ও গ্রন্থাগারের জায়গার অভাব হবে না। রাজার দান করা দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণের কাজ চলছে।’’

মুর্শিদাবাদের কর্ণসুবর্ণ, পাঁচথুপি (পঞ্চস্তূপ), সাগরদিঘি, জিনদিঘি, মহীপাল এলাকায় খননকার্যে পাওয়া প্রত্ন নিদর্শনের ভিত্তিতে আজ স্বীকৃত যে, ওই সব এলাকায় একদা বৌদ্ধ বিহার, জৈন মঠ, সেন ও পাল বংশের রাজধানী ছিল। নেহালিয়া রাজবাড়ি সূত্রে জানা যায়, জিনদিঘি সংস্কারের সময়ে ১৯০৮ সাল নাগাদ পার্শ্বনাথের প্রস্তরমূর্তি পাওয়া যায়। সাগরদিঘি থেকে সংগৃহীত একটি মূর্তি শিল্পী অর্ধেন্দুশেখর গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহায্যে এশিয়াটিক সোসাইটিকে দান করেন রায়বাহাদুর। তিনি নিজেও এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য ছিলেন। কলকাতা জাদুঘরেও তাঁর দান রয়েছে। জেলা ও জেলার বাইরে থেকেও মূর্তি, মুদ্রা-সহ প্রত্ন-নিদর্শন সংগ্রহের নেশায় বুঁদ ছিলেন রায়বাহাদুর।

১৯৫৭-১৯৫৯ নাগাদ তদানীন্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হুমায়ুন কবীরের তত্ত্বাবধানে জিয়াগঞ্জে ‘মুর্শিদাবাদ জেলা সংগ্রহশালা’ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই মতো রাজবাড়ির সামনে সংগ্রহশালার ভবন নির্মাণের জন্য রায়বাহাদুর জমি দান করেন। প্রত্নসামগ্রী ও গ্রন্থাগার সরকারের হাতে তুলে দেন। জেলাশাসককে সভাপতি এবং মহকুমাশাসককে সম্পাদক করে স্থানীয় বিধায়ক, পুরপিতা, জেলা তথ্য আধিকারিক ও রায়বাহাদুরের পরিবারের প্রতিনিধিকে সদস্য করে সংগ্রহশালা কমিটি গঠিত হয়। ভবন নির্মাণ করে উদ্বোধনের দিনক্ষণ স্থির করতে সময় লেগে যায় ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৯৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাক্কা ৩৪ বছর। কিন্তু সেখানেও গেরো।

রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিংহের মৃত্যুর কারণে ১৯৯৪ সালের ২৫ ডিসেম্বরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বাতিল হয়। পরে ফের দিন ধার্য হলে রাজ্যের পূর্তমন্ত্রী মতীশ রায়ের মৃত্যুতে পরবর্তী উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বাতিল হয়। ইতিমধ্যে অব্যবহারে ভবন নষ্ট হয়। লোপাট হয় বহুমূল্যের অনেক প্রত্ন নিদর্শন। সরকারি সূত্রে জানা যায়, ১৯৭২-৭৩ সালে রেজিস্ট্রশন অফিসার সুমেধা ঘোষ ‘মুর্শিদাবাদ জেলা সংগ্রশালা’র প্রত্ন সামগ্রীর একটি তালিকা করেছিলেন। ১৯৯২ সালে তৎকালীন রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহশালার অফিসার ইন-চার্জ প্রতীপকুমার মিত্র সেই তালিকাভুক্ত বহু নিদর্শন এমনকী, মধ্যুগীয় ধাতব মুদ্রারও অনেকগুলির খোঁজ পাননি ।

১৯৯২ সালে ‘মুর্শিদাবাদ জেলা সংগ্রশালা’র প্রত্ন নিদর্শনের যে তালিকা প্রতীপবাবু করেন তাতে তিনি দেখিয়েছেন, বহু নিদর্শনই আজ আর নেই। সেই তালিকায় রয়েছে— নবম শতকের ৮১ সেন্টিমিটার উঁচু চারদিকে শক্তিবেষ্টিত শিবমূর্তি, ১০৮ সেন্টিমিটার দীর্ঘ এবং ৫৪ সেন্টিমিটার চওড়া ১১ শতকের চারটি বিষ্ণুমূর্তি, নবম শতকের পঞ্চতারা বা বৌদ্ধতারার ৪৩০ সেন্টিমিটার দীর্ঘ এবং ২২০ সেন্টিমিটার চওড়া মাপের দু’টি মূর্তি, প্রজ্ঞাপারমিতার ১টি মূর্তি। দশম শতাব্দীর কারুকার্যময় ভাস্কর্যের ১৩৭ সেন্টিমিটার দীর্ঘ এবং ২৫ সেমি চওড়া পাঁচটি খণ্ড, ৯৩ সেন্টিমিটার দীর্ঘ এবং ২০ সেন্টিমিটার চওড়া একটি আরবি শিলালিপি, চাইনিজ ফুলদানি, টেরাকোটার ছাঁচ, কাপড়ের উপর আঁকা রামায়ণ, কৃষ্ণলীলা, জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার কাহিনি তিনটি। ১৯৯২ সালের ২৮ অক্টোবর এই নিয়ে মুর্শিদাবাদ থানায় সরকারের পক্ষ থেকে ডায়েরিও (নম্বর ২৬৭৪) করা হয়েছিল।

১৯৯৫ সালে ‘মুর্শিদাবাদ জেলা সংগ্রশালা’-র সদস্য ছিলেন প্রয়াত রায়বাহাদুরের পুত্র, অশীতিপর পূর্ণেন্দুনারায়ণ সিংহ। ওই বছর অক্টোবরে তিনি প্রকাশ্যেই অনুযোগ করেন, ‘‘বিদেশে প্রদর্শনীর জন্য ১৯৮০-৮৩ সাল নাগাদ তখনকার জেলা কালেক্টর (নাম মনে করতে পারেননি) চামুণ্ডা, প্রজ্ঞাপারমিতা বিষ্ণুমূর্তি-সহ বেশ কিছু প্রত্নমূর্তি ও নিদর্শন নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু আজও তিনি সে সব ফেরত দেননি।’’ সে সময়ে লালবাগের মহকুমাশাসক তথা ‘মুর্শিদাবাদ জেলা সংগ্রশালা’-র সচিব শান্তনু মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমিও ওই রকমই শুনেছি।’’

কিন্তু ওই পর্যন্তই। অবহেলার সেই ধারা এখনও অব্যাহত। জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ পুরপ্রধান শঙ্কর মণ্ডল বলেন, ‘‘পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে হলে সংগ্রহশালা চত্বরের সৌন্দর্যায়ন জরুরি ছিল। ভাল রাস্তাও গড়ে তুলতে হত। কিছুই হল না। অথচ জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জে পর্যটনের জন্য বরাদ্দ টাকা থেকে সাড়ে ২২ লক্ষ টাকা মহকুমাশাসক ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেই টাকা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।’’ লালবাগের মহকুমাশাসক প্রবীর চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘টাকা ফেরত গিয়েছে, তা সত্যি। জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জে পর্যটন বিকাশের স্বার্থে তা যাতে ফিরিয়ে আনা যায়, তার জন্য জেলাশাসকের কাছে লিখিত আবেদন জানিয়েছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE