অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী।
এপাং, ওপাং এবং নিশ্চিত ভাবে একটা ‘রেনি ডে’।
কী করে? মাঝখানে পিচ উঠে যাওয়া রাস্তার গর্তে একটা আলতো ঝপাং!
বৃষ্টির না হয় ‘মুড অফ’, তাই বলে রেনি ডে তো আর মার যেতে পারে না। বৃষ্টিটাও তেমনি বেআক্কলে। সকাল থেকে দিব্যি ঝরছিল। স্কুল যাওয়ার সময়ে দুম করে গুম মেরে গেল। অতএব, স্কুলের পথে জমা জলে গুছিয়ে একটা লাফ। সঙ্গে নীরব স্লোগান— নিজে ভিজুন, অন্যদেরও ভেজান। মুহূর্তে শুকনো জামাকাপড় ভিজে সপসপে। কাঁচুমাচু মুখে ক্লাসে ঢুকতেই প্রত্যাশিত সেই স্নেহমাখা নির্দেশ, ‘এ, হে! পুরো কাকভেজা হয়ে গিয়েছিস তো। শিগ্গির বাড়ি যা। ঠান্ডা লেগে যাবে তো!’’
ক্লাসের অন্য সহপাঠীদের চোখে-মুখে তখন জমাট মেঘ। টলটল করছে ঈর্ষা। রাগে, ক্ষোভে যেন এখনই ক্লাসরুমে ঝেঁপে বৃষ্টি নামবে! সঘন বর্ষায় ভিজতে না পারার কষ্টে ক্লাসরুমেও যে জমাট মেঘ জমে, কে জানত! স্কুলবেলার স্মৃতি হাতড়ালে উঠে আসবে এমন অজস্র ঘটনা।
চক ইসলামপুর শ্রীকৃষ্ণ চম্পালাল মাহেশ্বরী হাইস্কুলের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারিক তথা নাট্যকার দীপক বিশ্বাসের স্মৃতিতে আজও অমলিন কিশলয়-সহজ পাঠ। বর্ষা-বিকেলে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে তিনি বলে চলেন, ‘‘শৈশবে দুলে দুলে পড়তাম—‘দুই কূলে বনে বনে প’ড়ে যায় সাড়া/ বরষার উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া।’ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই আনন্দের মানেটাও গেল বদলে। বাদলা দিনে স্কুলে যাওয়ার অন্যরকম মজা ছিল। মনে মনে প্রার্থনা করতাম, ঝেঁপে বৃষ্টি আসুক। তা হলেই রেনি ডে।’’
কৃষ্ণনগরের প্রসেনজিৎ বিশ্বাস যেমন বলছেন, ‘‘বৃষ্টি থেমে গেলেই মনখারাপ হয়ে যেত। তখন বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে স্কুলে যাওয়ার পথে খুঁজতাম রাস্তার কোন গর্তে জল জমেছে। সেখানেই সবাই মিলে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে জামা-প্যান্ট ভিজিয়ে স্কুলে যেতাম। বলাই বাহুল্য, কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসতাম।’’
সকলেই যে বাড়ি ফিরতেন তা নয়, বইয়ের ব্যাগ নিরাপদ জায়গায় রেখে কেউ যেতেন ফুটবল মাঠে, কেউ ছিপ হাতে সটান পুকুরপাড়। আবার অন্য জলছবিও আছে। কয়েক বছর আগের কথা। প্রণব মুখোপাধ্যায় তখন রাষ্ট্রপতি। তিনি প্রধান অতিথি হয়ে এসেছেন বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের একটি অনুষ্ঠানে। বক্তৃতার সময় উঠে এল বর্ষাকালে তাঁর স্কুল যাওয়ার কথা। স্মৃতিচারণের ভঙ্গিতে তিনি জানান, জলকাদা ভেঙে স্কুলে যাওয়ার সময় সঙ্গে একটা গামছাও থাকত। দাঁড়েরমাঠের বৃদ্ধ ঋষি মণ্ডল হাসতে হাসতে বলছেন, ‘‘ঢাউস একটা ছাতা নিয়ে কেরু যেত আনন্দপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। রাস্তার মাঝে একটা খাল ছিল। বর্ষায় সেখানে বেশ জল জমত। ছোটখাট চেহারার কেরুর পক্ষে ওই খালটা পার হওয়া কঠিন হতো। তাই কেউ না কেউ ওকে কোলে করে পার করে দিত। অথচ হাজার ঝড়-বৃষ্টিতেও কোনওদিন স্কুল কামাই করত না কেরু। পরে সে যখন জোতদর্পনারায়ণপুর স্কুলে ভর্তি হল তখনও সে নিয়মে ছেদ পড়েনি।’’ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক প্রয়াত অনিল বিশ্বাসকে তাঁর গ্রামের লোকজন কেরু নামেই বেশি চেনেন।
শক্তিপুরের কাবিল মণ্ডল বলেন, “আমাদের ছেলেবেলায় এখনকার মতো বর্ষাতি ছিল না। বাড়িতে থাকত ঢাউস ছাতা। সেই ছাতার নীচে তিন-চার জন কোনও রকমে মাথা বাঁচিয়ে স্কুলে যেতাম। ছাতা না পেলে ভরসা ছিল কচুর পাতা।” একই অভিজ্ঞতা প্রাক্তন আইপিএস ডোমকলের নজরুল ইসলামেরও।
তবে রেনি ডে যেন একচেটিয়া স্কুলের সম্পত্তি। স্কুলে ঘণ্টা আছে, রোল কল আছে, প্রার্থনাও আছে। তবুও গোনাগাঁথা ছুটির বাইরে এ এক উপরিপাওনা। আর সেই আশ্চর্য দিনে স্কুলের সবথেকে গম্ভীর শিক্ষকের রুখু মেজাজও যেন ভিজে নরম হয়ে যেত। ত্রিকোণমিতির বদলে জানলার বাইরে তাকিয়ে তিনিও ফিরে যেতেন ছেলেবেলায়।’’ অঙ্কের পাতা ছিঁড়ে নৌকা তৈরি করার সময় কোনও শিক্ষক আবার বলতেন, ‘‘নৌকাটাও ঠিক করে তৈরি করতে পারিস না। এই, আর একটা কাগজ আমাকে দে তো!’’
টিনের চালে আছড়ে পড়ছে বৃষ্টি। শ্রাবণের মেঘদুপুরে এক চিলতে মাঠে গুরু-শিষ্যের নৌকা ভাসে। পাশাপাশি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy