Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
এক হাত ঘুরে রাসমণি কেনেন জমিদারি

ইতিহাস বুকে নিস্তব্ধ রানির কাছারি বাড়ি

রাজা ধর্মকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকায় রাজকর্ম দেখভালের দায়িত্ব বর্তায় রাজকর্মীদের উপরে। এর ফল যেমন হওয়ার কথা তেমনই হল নদিয়ার ক্ষেত্রেও। বছর শেষে কোম্পানির ঘরে জমা পড়ল না খাজনা। বাকি থাকা খাজনার দায়ে নিলাম হয়ে গেল নদিয়ারাজের উখড়া পরগনা।

জীর্ণ: সংস্কারের অপেক্ষায় রানির ঘাটের কাছারি বাড়ি। নিজস্ব চিত্র

জীর্ণ: সংস্কারের অপেক্ষায় রানির ঘাটের কাছারি বাড়ি। নিজস্ব চিত্র

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় 
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০১৯ ০৭:৩০
Share: Save:

তখন নদিয়ার সিংহাসনে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের প্রপৌত্র মহারাজ গিরীশচন্দ্র। ১৮০২ থেকে ’৪১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন আধ্যাত্মিক দিকে বেশি আগ্রহী গিরীশ।

রাজা ধর্মকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকায় রাজকর্ম দেখভালের দায়িত্ব বর্তায় রাজকর্মীদের উপরে। এর ফল যেমন হওয়ার কথা তেমনই হল নদিয়ার ক্ষেত্রেও। বছর শেষে কোম্পানির ঘরে জমা পড়ল না খাজনা। বাকি থাকা খাজনার দায়ে নিলাম হয়ে গেল নদিয়ারাজের উখড়া পরগনা। উখড়ার উত্তর দিক নিলাম থেকে কিনে নিলেন কলকাতার উঠতি জমিদার মধুসূদন সান্যাল। আর দক্ষিণ দিক কিনলেন কাশীনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।

সে কালে নবদ্বীপ ছিল উত্তর উখড়ার অন্তর্গত। কিন্তু জমিদারি কেনা আর তা ধরে রাখা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। উঠতি জমিদার মধুসূদন সান্যাল পারলেন না নিলাম থেকে কেনা জমিদারি বজায় রাখতে। তিনি বিক্রি করে দিলেন জমিদারি। কিনে নিলেন রানি রাসমণি। সালটা ১৮৫২। ইতিমধ্যে বদল হয়ে গিয়েছে নদিয়ার রাজসিংহাসনে। ১৮৪১ সালে গিরীশচন্দ্রের মৃত্যুর পরে রাজা হয়েছেন শ্রীচন্দ্র। খবর পেয়ে তিনি নিজেও উদ্যোগী হয়েছিলেন উখড়ার যে অংশের অন্তর্গত নবদ্বীপ সেটি পুনরায় কিনতে। সে কালে নদিয়ারাজ ‘নবদ্বীপাধিপতি’ উপাধি ব্যবহার করতেন। কিন্তু রাজত্বের মধ্যে নবদ্বীপই যদি না থাকে, তাহলে সেই উপাধি অর্থহীন হয়ে পড়ে। কিন্ত শ্রীচন্দ্র নবদ্বীপের জমিদারি উদ্ধার করতে পারেননি। সেটি রানি রাসমণির অধিকারে চলে যায়।

ইতিহাসের প্রায় ভুলে যেতে বসা এই অধ্যায় প্রসঙ্গে নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব জানাচ্ছেন, দেওয়ান কার্তিকেয় চন্দ্র লিখিত ‘ক্ষিতিশবংশাবলী চরিত’ থেকে বিষয়টি জানা যায়। জমিদারি কেনার পরেই তা দেখভালের জন্য রানি নবদ্বীপে একটি কাছারিবাড়ি পত্তন করেন। সেখান থেকেই চলত কাজকর্ম। নবদ্বীপের অন্যতম ব্যস্ত গঙ্গার ঘাট যেটি ‘রানির ঘাট’ নামে পরিচিত, সেই ঘাটেই তিনি নবদ্বীপে এলে স্নানাদি করতেন। সেই থেকেই ঘাটের ওই নামকরণ।

এখনও নবদ্বীপ শহরের গোকুলানন্দ ঘাট রোডে টিকে আছে সেই কাছারি বাড়ি। আটের দশক পর্যন্ত সেখানে কাজকর্ম চলত। কাছারি বাড়ির শেষ সক্রিয় মানুষটি ছিলেন বৃন্দাবন গোস্বামী। তাঁর মৃত্যুর পরে রানি রাসমণির কাছারি বাড়ির কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দু’এক ঘর ভাড়াটিয়া থাকেন সেই বাড়িতে। নবদ্বীপের গঙ্গার এক পরিত্যক্ত খাত যা ‘ছাড়া গঙ্গা’ নামে পরিচিত তার ধার ঘেঁষে গড়ে ওঠা সেই কাছারি বাড়ির ভিতরে আছে রাসমণি সেবিত রাধাগোবিন্দ জিউ ও গৌরাঙ্গ জিউর মন্দির। কাছারি বাড়ির ভিতর দিয়ে সিঁড়ি বাঁধানো ঘাট নেমে গিয়েছে ছাড়া গঙ্গার ধার বরাবর। বলা হয়, গঙ্গা দিয়ে নৌকায় এসে ওই ঘাটের সিঁড়ি দিয়েই কাছারি বাড়িতে আসতেন রানি রাসমণি কিংবা তাঁর জামাতা মথুরনাথ।

রানির ঘাট এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা তথা প্রাক্তন কাউন্সিলর স্বপনকুমার সান্যাল বলেন, “লোকমাতা রানি রাসমণির সঙ্গে নবদ্বীপের যোগাযোগ নিবিড়। এক সময়ে এটা ছিল রাসমণির এস্টেট। নবদ্বীপের মানুষ ওই কাছারি বাড়িতে খাজনা দিত। পড়ে বাম আমলে সেই ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তাতে কাছারির ঐতিহাসিক গুরুত্ব কমেনি। ওই বাড়ি এবং ঘাটের সংস্কার করা দরকার। পাশাপাশি ঘাটে যদি একটি রাসমণির মূর্তি বসানো হয়, খুব ভাল হয়। রানি তো ওই ঘাটেই বজরা বেঁধে নবদ্বীপে যাতায়াত করতেন।”

অতীতের সাক্ষী হয়ে দিন গুনছে রাসমণির নিস্তব্ধ কাছারি বাড়ি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

History Cottage Rani Rashmoni
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE