Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

মা তো ডিউটিতে গিয়েছে

সন্তানসন্ততি নিয়ে দেবী এলেন। মায়া সরকার বাড়ি ফিরলেন না। মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আয়ার ডিউটি সেরে মা কবে ঘরে ফিরবে— অপেক্ষায় রয়েছ একরত্তি দিশা।

শুভাশিস সৈয়দ
বহরমপুর শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৬ ০১:০৬
Share: Save:

সন্তানসন্ততি নিয়ে দেবী এলেন। মায়া সরকার বাড়ি ফিরলেন না।

মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আয়ার ডিউটি সেরে মা কবে ঘরে ফিরবে— অপেক্ষায় রয়েছ একরত্তি দিশা।

শরতের আকাশে কখনও তুলোর মতো মেঘ, কখনও মুখ ভার। সেজে উঠেছে পাড়া। বাড়ি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে সুন্দর কলোনি সর্বজনীন দুর্গাপুজো মণ্ডপ থেকে ভেসে আসছে মাইকে গান। কিন্তু একরত্তি মেয়েটির সে দিকে মন নেই।

মাথায় লাল ফিতে বেঁধে, ঠোঁটে লেপ্টে যাওয়া লিপস্টিক, কপালে টিপ, নতুন ফ্রক পরে তার সহপাঠীরা যখন পুজোর গন্ধ গায়ে মেখে হাত ধরাধরি করে পাড়া ঘুরছে, বাড়ির গ্রিলঘেরা একচিলতে বারান্দায় নিজের মনে দিশা পুতুল নিয়ে খেলা করেই চলেছে— ‘খেয়ে নাও সোনা। কাঁদে না। মা তো ডিউটিতে গিয়েছে। ফিরে আসবে এখনই। কান্না করলে কিন্তু মা কোনও দিনও আসবে না।’

কত বয়স হবে মেয়েটার ?

বাবা নির্মল সরকার জানান, এই শীতে সাত বছর হবে। কিন্তু ছটফটে প্রাণবন্ত মেয়েটা কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। তার বয়সী মেয়েরা যখন হই-হট্টগোল করে পাড়া মাতিয়ে খেলা করে বেড়ায়, তখন ও খাটের উপরে বালিশে মুখ গুঁজে পুতুল নিয়ে পড়ে থাকে।

বহরমপুরের বানজেটিয়া সুন্দর কলোনি এলাকায় নতুন পাকা বাড়ির ঘরের দেওয়ালে এখনও প্লাস্টার পড়েনি। মেঝেয় সিমেন্ট নেই। শোওয়ার ঘরে একটি খাট। তার উপরে তিনটে বালিশ এলোমেলো ভাবে পড়ে। ঘরের মধ্যে লাল টকটকে স্টিলের আলমারি। থরে থরে শাড়ি ভাঁজ করে রাখা।

নির্মল বলেন, ‘‘গত বছর পুজোর কত আগে ছেলেমেয়ের জন্য নতুন জামা কেনা হয়ে গিয়েছিল। আমাকেও জোর করে দোকানে টেনে নিয়ে গিয়ে পছন্দ করে শার্ট-ফুলপ্যান্ট কিনে দিয়েছিল। শাড়ি কিনেছিল নিজেও। তবে সব শাড়ি পরা হয়ে ওঠেনি। যেমন ছিল, তেমন পড়ে রয়েছে আলমারিতে।’’

গত ২৭ অগস্ট মুর্শিদাবাদ মেডিক্যালের দোতলায় ভিআইপি কেবিনে আগুন লাগলে নীচে নামতে গিয়ে হুড়োহুড়িতে পড়ে মারা যান মায়া। তার পর থেকেই চুপ করে গিয়েছে দিশা। সর্বক্ষণ নিজের মধ্যেই থাকে। স্ত্রীর মৃত্যুর পরে ছেলেমেয়ের যাবতীয় ঝক্কি একা হাতে সামলাতে হচ্ছে টোটোচালক নির্মলকেই। তিনি বলেন, ‘‘সকালে ঘুম থেকে তুলে খাইয়ে চলে যাই টোটো চালাতে। দুপুরে ফিরে মেয়েকে স্নান করিয়ে রান্না করতে বসি। কোনও দিন রান্না করতে দেরি হয়ে গেলে মেয়ে স্নানের পরেই ঘুমিয়ে পড়ে। দুপুরে ঘুম থেকে তুলে খাওয়ানোর চেষ্টা করি।’’

বিকেলে ফের টোটো নিয়ে বেরিয়ে পড়া। তখন বাড়ির উঠোনে তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে তাঁদের নবম শ্রেণিতে পড়া ছেলে সোমনাথ বসে থাকে বোনকে নিয়ে। রাতে বাড়ি ফিরে বাবা রান্না করার পরে খাওয়া। তত ক্ষণে বোন ঘুমিয়ে পড়ে। প্রতি বৃহস্পতিবার বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো করতেন মায়া। তাঁর চলে যাওয়ার পরে পুজোও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নির্মল গুনগুন করেন, ‘‘ঘরের লক্ষ্মী তো চলেই গিয়েছে আমাকে ছেড়ে। কী এখন পুজো করব বলুন তো?’’

সে দিন হাসপাতালের ডিউটিতে যাওয়ার সময়ে ছোট্ট দিশা মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরেছিল। যেতে দিতে চাইছিল না। মা তার হাত ছাড়িয়ে ‘আসছি’ বলে ডিউটি করতে চলে যায়। আর ফেরেনি। মেয়েও বারান্দা আঁকড়ে পড়ে, পাড়ার গলি দিয়ে যদি হঠাৎ মা-কে হেঁটে আসতে দেখে সে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

murshidabad medical college
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE