Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

স্কুল-বারান্দায় বিয়ের ভিয়েন

সামনের খোলা চাতালটায় গনগনে উনুনে ঢাউস কেলো কড়াইয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে শ’খানেক বেগুন ভাজা। তাঁর গা ঘেঁষে হন্তদন্ত হয়ে যাওয়ার সময়ে রাঁধুনীর ধমকও শুনতে হল তাঁকে, ‘‘দেখছেন তো রান্না বসেছে, তেল ছিটকোবে কিন্তু!’’

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

বিমান হাজরা
রঘুনাথগঞ্জ শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০১৭ ০২:৫৬
Share: Save:

স্কুলের গেট ডিঙোতেই হকচকিয়ে গিয়েছিলেন প্রধান শিক্ষক।

—এই তেল গরম হয়ে গেছে লুচিগুলো ছাড়!

সামনের খোলা চাতালটায় গনগনে উনুনে ঢাউস কেলো কড়াইয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে শ’খানেক বেগুন ভাজা। তাঁর গা ঘেঁষে হন্তদন্ত হয়ে যাওয়ার সময়ে রাঁধুনীর ধমকও শুনতে হল তাঁকে, ‘‘দেখছেন তো রান্না বসেছে, তেল ছিটকোবে কিন্তু!’’

ভুল জায়গায় চলে এলেন নাকি! তাঁর সতেরো বছরের সাধের কর্মস্থল দুলাল স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রাতারাতি এমন হুল্লোড়ে বিয়ে বাড়ি হয়ে উঠল কী করে!

কিঞ্চিৎ অস্বস্তি নিয়েই পাশ দিয়ে লুচির ঝাঁকা নিয়ে যাওয়া লোকটিকে জিজ্ঞেস করেন তিনি, ‘‘এটা কী হচ্ছে ভাই...?’’ উত্তর আসে, ‘‘দেখতেই তো পাচ্ছেন, লুচি-বেগুন ভাজা, শালপাতা টেনে বসে পড়ুন!’’

এ বার একটু মেজাজ চ়ড়তে থাকে পার্থসারথি বিশ্বাসের। ফরাক্কার যজ্ঞেশ্বরপুরের এক মাত্র প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক তিনি। পাঁচ গাঁয়ে দিব্যি পিরিচিতি তাঁর। পথে দেখা হলে সাইকেল থেকে নেমে , ‘হেঁ হেঁ ভাল আছেন স্যার!’ শুনতেই অভ্যস্থ তিনি। আর তাঁকেই কি না শুনতে হচ্ছে লুচি-বেগুন ভা...

ঝাঁকা হাতে লোকটা কাছে আসতেই এ বার এক ধমক লাগান তিনি, ‘‘বলি হচ্ছেটা কী!’’ লোকটি এ বার একটু হকচকিয়ে যায়, ‘‘আজ্ঞে বিয়ে!’’ পিছন ফিরে দেখেন, অন্য শিক্ষকেরাও গুটি গুটি ভিড় করেছেন তাঁর পাশে, স্কুলের লম্বাটে বারান্দায় তখন সার দিয়ে পাত পড়েছে। আর ঘাম মুছতে মুছতে রাঁধুনি তার অ্যসিস্ট্যান্টকে তড়পাচ্ছে, কী রে মাছটা বসিয়ে দে এ বার!’’

এ দিক ও দিক মাথা ঘুরিয়ে পার্থবাবুর নজরে পড়ে স্কুলের চার পাশে জটলা করেছে ছেলেপুলেরাও। হাঁ-মুখে বিয়ে বাড়ির কাণ্ডকারখানা গিলছে মিডডে মিলের রাঁধুনীরা।

এ বার বেজায় চটে বরকর্তাকে হাঁক পাড়েন পার্থবাবু। আর কাজ হয় তাতেই। ব্যস্ত বিয়ে বাড়ি জুড়ে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। হাত জোর করে তাঁর সামনে এসে দাঁড়ান স্বয়ং বর প্রসেনজিৎ রায়। মিনমিনে গলায় বলেন, ‘‘বেজায় বৃষ্টি তো, সব ভেসে গিয়েছে। স্কুলেই উঠে এলাম তাই। রাগ করলেন স্যার!’’ তা একটু করলাম বইকি, বলার খুব ইচ্ছে হল পার্থবাবুর। কিন্তু তার আগেই মিডডে মিলের রাঁধূনীরা হই হই করে উঠলেন, ‘‘ছেলেগুলো খাবে কি, রান্নাঘরের সামনেই যে ভিয়েন বসেছে স্যার।’’

কোনও অনুমতি ছাড়াই স্কুলবাড়ি বিয়ে বাড়িতে বদলে যাওয়ায় শুক্রবার এ ভাবেই বন্ধ হয়ে গেল ওই প্রাথমিক স্কুল। কিন্তু প্রশ্ন, অনুমতি দিল কে? ‘‘ফরাক্কার বাড়ি থেকে ঘুণাক্ষরেও টের পাননি যে তলায় তলায় এমন কিছু ঘটতে চলেছে’’, বলছেন পার্থবাবু। তা হলে? খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, এ কাণ্ডের পিছনে রয়েছে স্কুলেরই এক পরোপকারি পার্শ্ব শিক্ষক। স্কুলের চাবি থাকে তারই কাছে। দরাজ হয়ে সেই খুলে দিয়েছিল স্কুল। আর রাতারাতি ভিয়েন বসিয়ে, ম্যারাপ খাটিয়ে, আস্ত দুলাল স্মৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়ে উঠেছিল বিয়ে বাড়ি।

কিন্তু কী করণীয়? বিডিওকে বিস্তারিত ঘটনা জানিয়ে শেষতক রণে ভঙ্গ দিলেন পার্থবাবু। ছেলেরাও শাল পাতায় লুচি আর হাফ-বেগুনভাজার ভাগ পেয়ে ফিরে গেল বাড়ি।

তবে ঘটনাটি কানে যাওয়ায় সটান স্কুল এসে হাজির বিডিও কেশাং ধেনডুপ ভুটিয়া। তিনি এসেই জানিয়ে দেন, অনেক হয়েছে এ বার গোটাও। স্কুল বেঙেই গিয়েছিল, দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে বাড়িও ভেঙে দেন তিনি!

মাঝ পথেই থমকে যায় মাছের ঝোল। শূন্য-লুচি ফুটতে তাকে কড়াই!

পার্থবাবু জানান, ক’দিন আগে কয়েকজন গ্রামবাসী তাঁকে স্কুল ঘর নেওয়ার কথা বলতে এসেছিল বটে, তবে সটান ‘না’ করে দিয়েছিলেন তিনি। তা সে কথা যে কানেই তুলবেন না গ্রামবাসীরা বুঝবেন কী করে!

তবে, গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য সিপিএমের অনিল সরকার গ্রামবাসীদের পাশেই রয়েছেন, বলছেন, “গরীবের বাড়ির বিয়ে। প্যান্ডেল করার সামর্থ্য ছিল না, তাই স্কুলে রান্না-বান্না করছিল। কী এমন হয়েছে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Raghunathganj রঘুনাথগঞ্জ
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE