ঘর তাঁদের অপেক্ষায় থাকে। সম্বৎসরে হাতে গোনা কয়েকটি দিন। ঘরের ছেলে ঘরে ফেরে। রঙিন হয়ে ওঠে সাদাকালো গ্রামগুলো। খুশির বাঁধ ভাঙে সীমান্তে।
তাই পরবের সময় এগিয়ে এলেই ঘন ঘন ক্যালেন্ডার দেখেন বাড়ির লোকজন। মোবাইলে ফোন করে বাড়ির খুদে, ‘‘ও আব্বা মনে আছে তো? এ বারের ইদে আমার কিন্তু একটা টকটকে লাল রঙের চুড়িদার চাই।’’ হিসেবি কর্ত্রী ফোন নিয়ে আড়ালে চলে যান। ফিসফিস করে বলেন, ‘‘শোনো, মুড়ি-মুড়কির মতো টাকাপয়সা সব খরচ করে ফেলো না যেন। সামনে অনেক খরচ।’’
ফোনের ও প্রান্ত থেকে আশ্বাস আসে, ‘‘কিচ্ছু ভেবো না। ওভার ডিউটি করে টাকা জমিয়েছি। এ বারের ইদটা সবাই মিলে খুব হইহই করে কাটাব।’’ মুর্শিদাবাদের বহরমপুর, লালবাগ, ডোমকল, বেলডাঙা, হরিহরপাড়া, কান্দি কিংবা ধুলিয়ান তাই অপেক্ষায় ছিল। ঘরের ছেলেরা এ বার ঘরে ফিরবে। হইহই করে কাটবে ক’টা দিন। কিন্তু কেরলের বান সব হিসেব ওলটপালট করে দিল।
বুধবার ইদুজ্জোহার দিনেও তাই বহু পরিবারের মনখারাপ। কেউ খেতে বসেও খেতে পারলেন না। বললেন, ‘‘ছেলেটা কেরলে আটকে পড়েছে। পরবের দিনেও বাড়ি ফিরতে পারল না। আমি কী করে খাই, বলুন তো?’’ কেউ নমাজ সেরে চোখের জল মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরলেন। বললেন, ‘‘প্রতি বছর ইদে বাপ-ব্যাটায় একসঙ্গে নমাজ পড়ি। এ বারে ছেলেটা কেরল থেকে আসতে পারল না।’’
হরিহরপাড়ার পিরতলা ইদ্গাহ ময়দানে ইদুজ্জোহার নমাজের শেষে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন বছর উনিশের রিন্টু শেখ। রিন্টুও কেরলের বানে আটকে পড়েছেন। বাড়ি ফিরতে পারেননি। তাঁর বাবা দিদার শেখ জানাচ্ছেন, ছেলের সঙ্গে মোবাইলে তাঁর কথা হয়েছে। এর্নাকুলামে একটি বাড়ির তিন তলায় ত্রিপল টাঙিয়ে রিন্টু ও কয়েক জন আছেন। দিদার বলছেন, ‘‘তিন বছর ছেলেটা কেরলে আছে। প্রতি বছর ইদের আগে বাড়ি ফিরত। এ বারই পারল না।’’ ছেলে পরবে আসতে না পারায় নাগাড়ে কেঁদে গিয়েছেন রিন্টুর মা ও দিদি। রিন্টুর মা বলছেন, ‘‘ছেলেটা কেমন আছে, খাওয়া জুটেছে কি না আল্লাই জানে।’’
প্রতি বছর ইদের আগেই ঘরে ফেরেন লালবাগের ডাঙাপাড়ার নজরুল শেখ। এ বারই সেই নিয়মের অন্যথা হল। দিন চারেক আগে বাড়িতে ফোন করে তিনি জানিয়েছিলেন, জল নেমেছে বটে। তবে কাজ নেই। ঘরে ফিরে আসার মত টাকাও নেই। ব্যস, ওইটুকুই। তার পরে আর নজরুলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি তাঁর বাড়ির লোকজন।
নজরুলের বছর পাঁচেকের ছেলে ফিরোজ বলছে, ‘‘আব্বা বলেছিল, ইদের আগেই বাড়ি ফিরে নতুন জামা কিনে দেবে। কিন্তু আব্বাই এল না।’’ নজরুল এর্নাকুলামে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। এক বছর হল কোনও রকমে ধার-দেনা করে মাথা গোঁজার মত একটা বাড়ি করেছেন তিনি। মাসে মাসে তাঁর পাঠানো টাকায় সংসার চলে। আর দেনা শোধ হয়।
তবে এ মাসে তিনি কোনও টাকা পাঠাতে পারেননি। নজরুলের স্ত্রী কাজল বিবি ছেলেমেয়েকে নিয়ে ম্লান মুখে বসে আছেন। কাজল বলছেন, ‘‘চার দিন আগে ফোনে ওর সঙ্গে কথা হয়েছে। সে দিন বলল জল নেমেছে। কিন্তু এখনও ফেরা কঠিন। ওখানেও কাজ নেই বেশ কয়েকদিন। টাকাপয়সাও নেই মানুষটার কাছে। তবে ছেলেমেয়ে দু’টোর জন্য খুব খারাপ লাগছে। ওরা সমানে বলে চলেছে, ‘সকলের বাড়িতে ইদ হচ্ছে। আমাদের বাড়িতে কেন কিছু হচ্ছে না?’ কী বলি বলুন তো!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy