Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

সাদাকালো অ্যান্টেনা

মাথার ভিতর ভুরভুরি কাটে নাদের আলি, ঘুমঘুম ক্লাসরুম, ছাদের অ্যান্টেনা কিংবা ঠাকুমার মুখে শোনা শাঁকচুন্নি, বেম্মদত্যি।

সুদীপ ভট্টাচার্য
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৭ ০২:২০
Share: Save:

বোকা বাক্স

প্রথম টিভি দেখেছিলাম কোনও এক পড়ন্ত বিকেলে। মায়ের এক বন্ধুর বাড়িতে। এত মানুষ, গাড়ি, গাছ সব এই ছোট্ট বাক্সে আঁটলো কী করে! এরা কী খায়? কী করে থাকে? টিভি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়েছিলাম টেবিলের দিকে। বোবা বাক্সের গায়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করেছিলাম, ভিতরের চরিত্ররা কী কথা বলছে। নাহ্, শুনতে পাইনি। মা-ও খুলে বলেনি কিছু। শুধু বলেছিল, পড়াশোনা না করলে ওই বাক্সের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।

তা হলে ওরা হাসে কেন? উত্তর মেলেনি সে দিন। নিজের মতো করে উত্তর খুঁজে নেওয়ার মতো বড় হয়নি তখনও। তাই তো ছটফট করতাম জানার জন্য। বাবার কাছে বায়না করতাম, আমাদের ওই রকম একটা টিভি চাই। শেষতক রাজি হল বাবা।

কলকাতায় এক টিভির দোকানে নিয়ে গিয়েছিল বাবা। বেশিরভাগ সাদা কালো। দু’একটা রঙিন। বারবার শুধু মনে হচ্ছিল, শুধু পড়াশোনা না করার জন্য এতগুলো মানুষকে এ ভাবে বাক্সে ঢুকিয়ে রাখা? এটা কিন্তু খুব বড় শাস্তি। বড় কষ্টের। যাইহোক, টিভি এনে রাখা হল টেবিলে। ছোট্ট লাল টেলেরামা। একজন এসে অ্যান্টেনা জুড়ে দিল ছাদে। উড়ে এসে বসল কাক। হু...স, যাঃ...আ...! কাক যায় না। দোল খায়। অ্যান্টেনাও নড়তে থাকে। দুলতে থাকে টিভির মানুষ, ঘরবাড়ি, রাস্তঘাট। চোখে ঝিলমিল লেগে যায়।

এরই মধ্যে কেউ সটান উঠে পড়ত ছাদে। একজন টিভির সামনে। উঠোনে আমি। মিডলম্যান। পাখি তাড়িয়ে অ্যান্টেনা বাগে আনতে আনতে উপর থেকে আওয়াজ আসত— ঠিক আছে? মিডলম্যানের কাজ, সেই কথাটাই টিভির সামনে পৌঁছে দেওয়া। তারপর একই ভাবে উপরের জনকে— আর একটু, আর একটু। ডান দিকে, হ্যাঁ, এ বার ঠিক আছে।

ঝিলমিল ঠিক। থিকথিকে ভিড় টিভির সামনে। পর্দা জুড়ে কত হাসি, কান্না, মনকেমন। এক নির্জন দুপুরে ভাতের থালা নিয়ে বোকা-বাক্সের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, ‘‘তোমাদের খিদে পায় না? এই দ্যাখো খাবার এনেছি। খাবে?’’ কেউ সাড়া দেয়নি। শুধু পিছন থেকে হাসতে হাসতে মা এসে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘‘বোকা কোথাকার!’’

আয় ঘুম

তখন ক্লাস থ্রি। বাংলা ক্লাস। দিদিমনি স্মৃতিদি। ‘রিমঝিম’ দিয়ে বাক্যরচনা করতে হবে। সকলেই খসখস করে লিখছে। ঘুমঘুম ক্লাসে আমিই কেবল আকাশ-পাতাল ভাবছি। অনেক ভেবে, মাথা চুলকে লিখেছিলাম— রিমঝিম লোকে খায়। রিমঝিমকে কেন খাবার মনে হয়েছিল আমি আজও বুঝতে পারিনি।

বাড়ি এসে যথারীতি মায়ের বকুনি, ‘এটা কী লিখে এসেছিস? লিখতে পারতিস, রিমঝিম বৃষ্টি পরে। শুনিসনি কোনও দিন?’ সত্যিই শুনিনি। সিঁড়ির ঘরের টিনের চালে টুপটাপ বৃষ্টির শব্দ শুনেছি। শনশন হাওয়া শুনেছি। শীতের বৃষ্টিতে কুকুরছানার কুঁইকুঁই কান্নাও শুনেছি। কিন্তু রিমঝিম? নাহ্!

এখনও মাঝে মাঝে বৃষ্টিরাতে ঘুম ভেঙে যায়। বৃষ্টির ছাটে ভেসে আসে ছেলেবেলা। তখনও তো এমন বৃষ্টির রাত। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ। কিছুতেই ঘুম আসত না। পাশে শুয়ে থাকা ঠাকুমার মুখে রামায়ন, মহাভারতের কত গপ্প। এক সময় মহাভারতের যুদ্ধ থেমে গিয়ে শুধুই নাক ডাকার আওয়াজ।

ঠাকুমা ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার চোখে ঘুম নেই। কাল সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে তির-ধনুক তৈরি করতে হবে। কিন্তু একটা তির ছুড়লে কোন মন্ত্রে তা দশটা হয়ে যাবে সেটা বুঝতে পারছি না।

পাশের ঘর থেকে মা ঘরে আসেন, ‘কী রে, ঘুমোসনি এখনও? তাহলে উঠে পড়তে বোস।’ ব্যাস! বইয়ের নাম শুনেই সারা পৃথিবীর ঘুম নেমে আসতো দু’চোখে। এখনও কোনও কোনও রাতে ঘুম ভেঙে যায়। বই নিয়ে বসলেও ঘুম আসে না। ফোটোগ্রাফির বইয়ের পাতায় পাতায় রামায়ণ-মহাভারতের ছবি। ঠাকুমা বলেন, ‘তারপর সে কী যুদ্ধ রে ভাই।’ ভেসে আসে স্মৃতিদির গলা, ‘রিমঝিম দিয়ে একটা বাক্য গঠন করো তো।’ দু’চোখ জুড়ে বৃষ্টি নামে।

হারানো ভূত

সন্ধ্যা নামলেই বাঁশবাগানের ফাঁক দিয়ে টিমটিমে একটা আলো দেখা যেত। নিটোল অন্ধকারের মধ্যে ওই আলোটা বড্ড চোখে পড়ত। মা বলতেন, ওটা ভালবাসার আলো। ওটা দেখলে ভাল ছেলে হয়ে থাকতে হয়। না হলেই কিন্তু বিপদ!

বিপদটা যে কী, তা কোনওদিন মা বলেনি। আমিও জানার চেষ্টা করিনি। আসলে বাঁশবাগান মানেই তো একটা গা ছমছমে ব্যাপার। রাতে ভূত, পেত্নি, শাকচুন্নি, বেম্মদত্যিদের রাজত্ব। সন্ধ্যার পরে সেখানে আলো জ্বলে। কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলে, নাকি সুরে গান গায়। কেউ কেউ খোনা গলায় কেঁদে ওঠে, হিঁ...হিঁ করে হাসে।

ফলে ভয়ে কাঠ হয়ে চুপটি করে ভাল ছেলে হয়ে বসে থাকতাম। শুধু কি তাই! ঠাকুমার মুখেও কতশত ভূতের গপ্প। আসলে সে সব নাকি সত্যি! শনি, মঙ্গলবার রাতে এক পোড়ো জমিদার বাড়িতে নূপুর পায়ে এক মেয়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। তারপর দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠে মিলিয়ে যায় চিলেকোঠার ছাদে। বহু দূর থেকে সেই নূপুরের আওয়াজ শোনা যেত। শীতের রাতে লেপের তলায় সে গপ্প শুনতে শুনতে জড়িয়ে ধরতাম ঠাকুমাকে। তারপর নিশি, ভুলোদের কাহিনি শুনতে শুনতে পাড়ি দিতাম ঘুমের দেশে।

দিব্যি বইছিল জীবন। একদিন বাবা বলল, ‘গ্রামে পড়াশোনাটা আর হবে না। শহরে যেতে হবে। আমি বাড়িভাড়া ঠিক করেছি। সবাই ওখানে গিয়েই থাকব।’ ঠাকুমার চোখে জল। আমার মনকেমন। এ সব ছেড়ে চলে যাব! লোটাকম্বল পিঠে করে মেঠো পথে ধুলো উড়িয়ে শহরের উদ্দেশে পাড়ি দিল ট্রাক। পিছনে বেশ কিছুটা পথ ছুটে এল আমার বন্ধুরা আর কালো রঙের কুকুর, কালু। তারা একসময় থেমে গেল। আবছা হয়ে গেল বাঁশবাগান, ভিটেবাড়ি, আমার গ্রাম। শহরের নিয়ন আলোয় হারিয়ে গেল মামদো, শাকচুন্নি, বেম্মদত্যিরাও। সব কি আর গুগল জানে!

একবার সাধিলেই

কী এমন অন্যায় করেছি, শুনি!

পাড়ার মোড়ে কেন লোকটা বাঁশি বাজিয়ে আইসক্রিম বিক্রি করতে আসে?

আর গলার জোরও তেমনি!

‘ওগো, টিন ভাঙা, লুহা ভাঙা, পয়সা দিয়ি আইসক্রিম লেবে গো....।’

তারপরেই বাঁশিতে ফুঁ।

কী এমন অন্যায় করেছি, শুনি!

শুধু তো একটা আইসক্রিম খেতে চেয়েছিলাম! শক্ত কাঠির উপরে টকটকে লাল রঙের আইসক্রিম! আহা, কী দারুন খেতে!

অথচ মা রেগে গিয়ে বললেন, ‘বাড়িতে দুধ-ছানা আছে। সেগুলো খেতে ইচ্ছে হয় না? রোজ রোজ আইসক্রিম খাওয়া কীসের!’

আমিও ছাড়ার পাত্র নই। জেদ ধরলুম, ‘আইসক্রিম আমি খাবই।’

কেউ সাড়া দিল না। মা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকল। এত অবজ্ঞা? আমার রাগের কোনও দাম নেই?

সটান উঠোনে নেমে ধুলোয় গড়াগড়ি। পরিষ্কার জামা কাপড় ধুলোয় সাদা। হাঁটুটাও গেল ছড়ে।

সঙ্গে সঙ্গে মা ছুটে এসে পিঠে দিল দমাদম। একে হাঁটু জ্বলছে। ও দিকে উপরি পাওনা পরপর তিনটে কিল। চোখ দু’টো জ্বালা করছে। এখনই কেঁদে ফেলব। কিন্তু সবার সামনে কাঁদতে নেই। মনখারাপ হলে ছাদে। কান্না পেলে চিলেকোঠায়।

ভরসন্ধ্যায় সেখান থেকে ডেকে আনল ঠাকুমা। খিদেতে পেটের নাড়ি ছিঁড়ে যাবার জোগাড়। কিন্তু খাব না। আমার রাগের বুঝি দাম নেই?

গম্ভীর গলায় মা, ‘হাত মুখ ধুয়ে খেতে বোস।’

আদর করে ঠাকুমা, ‘সোনা বাবা আমার, খেয়ে নাও। সেই কখন খেয়েছ?’

হাসি মুখে বাবা, ‘নে নে, অনেক রাগ হয়েছে। এ বার খেতে আয়।’

কিন্তু আমি কারও কথায় কান দিচ্ছি না। গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কলতলাতে যাব না, খাব না, ঘুমোবও না। বকলেই তো হতো, মারল কেন?

আবার কান্না পাচ্ছে। কিন্তু চিলেকোঠায় যাওয়া যাবে না। সেখান থেকে বাঁশবাগানটা দেখা যায়। আর সেই আলোটা...

মা ফের রেগে গেলেন, ‘ঠিক আছে। কেউ ওকে খাওয়ার কথা বলবে না। এই বয়সে এত জেদ আসে কোথা থেকে? দেখি, ক’ দিন না খেয়ে থাকতে পারে?’

আমি ঘরে চুপ করে বসে রয়েছি। রাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পেটে ইঁদুর দৌড়চ্ছে। ঘড়িতে ঢং ঢং করে দশটা বেজে গেল। কিন্তু আর তো কেউ খেতে বলছে না। সবাই কি ঘুমিয়ে পড়ল? আমি কি তাহলে সারা রাত না খেয়ে থাকব? না খেয়ে আমি যদি মরে যায়? মনে মনে ভাবছি, একবার সাধিলেই যাইব।

ঠিক তখনই খুট করে মিটসেল্ফ খোলার আওয়াজ। থালা হাতে ভাত মাখতে মাখতে এগিয়ে এলেন ঠাকুমা। মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘এ বার খেয়ে নে। নইলে শরীর খারাপ করবে। ঠাকুমা খাইয়ে দিচ্ছেন। আর আমি খাচ্ছি আর কাঁদছি।’ ঠাকুমা বলছেন, ‘ইস! মুখটা শুকিয়ে একেবারে আমসি হয়ে গেছে রে।’

খাওয়া শেষ। ঠিক তখনই পাশের ঘর থেকে মায়ের গলা, ‘বীরপুরুষের খাওয়া হল? এ বার চুপ করে ঠাকুমার পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়বি। কাল বিকেলে আইসক্রিম কিনে দেব।’

নতুন জন্ম

গাঁয়ে বানের জল ঢুকেছে। খেত-খামার ডুবেছে আগেই। ঘোলা জলের ঢেউ লেগেছে বসতবাড়িতেও। পাশের জঙ্গলেও জল থইথই। বানের জল তার মাথা ছুঁলো। কতই বা বয়স তখন! বড়জোর মাস চারেক। জলের উপর ভেসে ছিল সবুজ পাতা। মাসখানেক জলে ডুবে থেকে তার আশপাশের সঙ্গীরা সবাই মারা গেল। বেঁচে থাকল সে। তারপর জল নামতেই তরতরিয়ে বাড়তে শুরু করল।

বেশ কয়েক বছর পরে মরতে মরতে বেঁচে যাওয়া সেই গাছ তখন প্রাপ্তবয়স্ক। চারপাশে এখন তার পড়শিও অনেক। ডালপালা মেলে সবাই সবাইকে ছুঁয়ে থাকে। জঙ্গলে গেলেই সেই গাছটাকে একবার জড়িয়ে ধরত ছেলেটা। তার সঙ্গী কুকুরটা বসে পড়ত গাছতলায়। কারণ, সে-ও জানে তার মনিব এখন গাছটাকে একটু আদর করবে।

বার্তাটা রটে গেল আচমকাই। জঙ্গলের গাছ কাটা হবে। ছ্যাঁত করে উঠল ছেলেটার বুক। খেতে গেলে কান্না পায়। স্কুলে গেলে মনকেমন। তার আশঙ্কাই সত্যি হয়। বন্ধু গাছটার সঙ্গে সঙ্গে কাটা পড়ল আরও কয়েকটি গাছ। ঘুমের মধ্যেও ছেলেটি করাতের আওয়াজ পায়। বিকেলে সে আর তার পোষা কুকুর দু’জনেই বসে থাকে গোমরা মুখে। ছেলেটা আর জঙ্গলের পথ মাড়ায় না। কুকুরটা সেদিকে তাকিয়ে মাঝেমধ্যে ডেকে ওঠে—ভৌ।

বর্ষা নেমেছে। সবুজ হয়ে উঠেছে আশপাশ। বৃষ্টি ধরে আসা এক বিকেল। ছেলেটা বেরিয়ে পড়ল। তার হাতে একটা গাছের চারা। সঙ্গী সেই কুকুরটা। কাটা গাছটার কাছে যেতেই কে যেন ফিসফিস করে উঠল, ‘এই দ্যাখ, আমি!’ চমকে ওঠে ছেলেটি। সে দেখে গাছের কাটা কাণ্ডটার পাশ দিয়ে বেরিয়েছে বেশ কয়েকটি কচি সবুজ পাতা। তার উপর টুপ করে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা নোনতা জল। চারাটা পুঁতে চোখ মুছে ছেলেটা বলল, ‘দু’জনেই বেড়ে ওঠ তরতরিয়ে!’

শিবুর মা

ভোজবাড়িতে এলাহি আয়োজন। আর পাঁচ জনের সঙ্গে খেতে বসেছে শিবুর মা। অনুষ্ঠান বাড়িতে এই বৃদ্ধা অন্যদের থেকে যেন একটু আলাদা। মলিন পোশাক। জবুথবু শরীর। দাঁতে স্পষ্ট দোক্তার ছাপ। শিবুর মায়ের পাতে ভাত, তরকারি, মাংস। আস্তে আস্তে খাচ্ছেন তিনি।

বাড়ির কর্তা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলে গেলেন, ‘ও শিবুর মা, ভাল করে খেয়ো কিন্তু। যা লাগবে চেয়ে নেবে। এই ফড়িং, পিসিকে আরও দু’পিস মাংস দিয়ে যা।’ শিবুর মায়ের মুখে হাসি। ফড়িং মাংস দিয়ে গেল। কিন্তু শিবুর মা সে সব দাঁতেও কাটছে না। মাংসগুলো সরিয়ে রেখেছে পাতার একদিকে। নিজের জন্য ডাল, তরকারি আর মাংসের একটু চর্বি।

খেতে খেতেই শিবুর মা বলে চলে, ‘বুঝলে ভাই, এরা বড় ভাল মানুষ। এই বিরাট বাড়ি আগে সর্বক্ষণ গমগম করত। এখন তো সব শহরে চলে গিয়েছে। এ বাড়ি ফাঁকা পড়ে থাকে। ছেলের পৈতে তো। তাই জন্মভিটেতে এই অনুষ্ঠান। এ সব হয়ে গেলে বাড়ি ফের ফাঁকা। তখন একা একাই নিজের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঘরদোর সব সাফ করব। আচ্ছা বাবা, একদিন সবাই শহরে চলে যাবে? গ্রামে কেউ থাকবে না?’

এর কোনও উত্তর আমার জানা ছিল না। শুধু দেখলাম, খাওয়া শেষ। শিবুর মা ফাঁকা জলের গেলাসে পাতের মাংসগুলো তুলে রাখছে। চোখে চোখ পড়তে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। বলল, ‘নাতিটা বড় মাংস খেতে ভালবাসে। অভাবের সংসারে বাড়িতে তো তেমন মাছ-মাংস আসে না। মাস চারেক আগে এক বার ছেলে মাংস এনেছিল। খুব তৃপ্তি করে সে দিন খেয়েছিল নাতিটা। আজকেও ভাত না খেয়ে বসে আছে। আমি গেলে এই মাংস দিয়ে ভাত খাবে।’ আপনি তো ওর জন্য আলাদা ভাবে চেয়ে নিতে পারতেন! বাড়ির কর্তা তো আপত্তি করত না। আমি বলব? হাত চেপে ধরে শিবুর মা, ‘দোহাই ভাই, এমন কাজ কোরো না। এ বাড়িতে আমার নিমন্ত্রণ। আমি এসেছি। হাত পেতে কারও কিছু চাইতে পারি না ভাই!’

স্মৃতির সুতো

দরকারি কিছু কাগজ স্টেপল করতে হবে। এ দিক, ও দিক খুঁজে স্টেপল তো মিলল। কিন্তু পুরু কাগজে পিন ঢুকছে না! অগত্যা, সেই পুরনো পথ। বিরক্তি হয়েই খোঁজ করলাম, ‘সূঁচ-সুতোটা কই গো?’

সঁূচ-সুতো দেওয়ার কথা ছিল গিন্নির। কিন্তু সাড়া দিলেন সেই চেনা মুখ। পরনে দুধসাদা ধুতি-পাঞ্জাবি। মোটা গোঁফ। চোখে পুরু ফ্রেমের চশমা। ধীরে ধীরে তিনি এগিয়ে আসছেন আমার দিকে। হাতে অতিরিক্ত পাতা আর সুতো। চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম টিভি, ফ্রিজ, কম্পিউটর, আয়না, চিরুনি-সহ ঘরের সব জিনিসপত্র উধাও। তার জায়গায় সারি দেওয়া বেঞ্চ। দেওয়াল জুড়ে ঢাউস ব্ল্যাকবোর্ড। ইতিউতি পড়ে রয়েছে ক্ষয়ে যাওয়া চকের টুকরো। গোটা পঞ্চাশেক ছাত্র গম্ভীর মুখে পরীক্ষা দিচ্ছে। পরনে নীল প্যান্ট, সাদা শার্ট।

—‘তুমিই তো সুতো চাইলে?’

—‘হ্যাঁ, স্যার।’

—‘সব প্রশ্নের উত্তর লিখেছ তো?’

—‘হ্যাঁ, স্যার!’

মনে মনে বললাম জীববিদ্যা আমার প্রিয়। কিন্তু যদি আর একটু সময় পেতাম! এ দিকে ঢং ঢং করে ঘণ্টার আওয়াজ শুনতেই বুকের মধ্যে কেমন কেমন। সব ঠিক লিখলাম তো? সব পাতাগুলো সেলাই হল তো?

উত্তরপত্র সংগ্রহ করতে করতে আবার সেই গম্ভীর গলা—‘এই বিকাশ, তোর খাতা তো খুলে গিয়েছে রে। ঠিক করে বাঁধিসনি কেন? এ দিকে আয়।’

ঠিক সেই ফাঁকে ভয়ে ভয়ে স্যারকে বললুম, ‘আমাকে আরও একটা সুতো দেবেন, স্যার?’

—‘কেন, তুই তো খাতা জমা দিয়ে দিয়েছিল। আবার সুতো কেন?’

মাথা নীচু করে চলে যাচ্ছি। ফের পিছন থেকে সেই ভারী গলা—‘কী রে চলে যাচ্ছিস যে! সুতো নিবি না?’ একটা নয়, স্যার হাতে গুঁজে দিলেন বেশ কয়েকটি সুতো। সুতো তো নয়, যেন লটারি জেতা! সে জিনিস অন্য কোনও কাজে লাগত না। কিন্তু টুকরো সে সুতো পকেটে পুরে বাড়ি ফেরার যে কী আনন্দ!

‘সূঁচ-সুতো নেবে না? তখন থেকে ডেকে যাচ্ছি। সাড়া না দিয়ে হাঁ করে বসে আছ!’ ঘোর কাটল গিন্নির গলা শুনে।

পাখার হাওয়ায় ঘরময় উড়ে বেড়াচ্ছে আমার দরকারি কাগজ।

পাতাল কেঁচো

টগর গাছটার গোড়ায় ছোট্ট ফুটো করে নরম মাটি তুলেছে কেউ। সেটা দেখে খুড়তুতো ভাই বলল, ‘দাদা এই হচ্ছে সেই জায়গা। চল খুঁড়ে দেখি।’ ঘর থেকে নিরেন এনে দু’জনেই লেগে পড়লাম কাজে। আর একটু খুঁড়লেই নির্ঘাত দেখা মিলবে পাতাল রেলের। গর্ত একটু একটু করে গভীর হচ্ছে। আর মাঝেমধ্যেই কান পেতে শোনার চেষ্টা করছি, মেট্রো রেলের আওয়াজ। গ্রীষ্মের রোদে দরদর করে ঘামছি দু’জনেই। কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই কারও। আর একটু খুঁড়লেই দেখা মিলবে ট্রেনের!

ক’দিন আগেই কলকাতায় মামার বাড়ি বেড়াতে গিয়ে দেখে এসেছি পাতাল রেল। উফ, সে কী অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। তারপর থেকেই মনে হয়েছে, কলকাতায় যখন এমন জিনিস আছে, আমাদের গ্রামেও আছে। আসলে ওই ট্রেন তো আর এই কু...ঝিক...ঝিক নয়, এরা চলে মাটির তলায়। আর সেই কারণেই উপর থেকে কেউ কিচ্ছুটি টের পায় না।

অতএব, অগাধ বিশ্বাসে মাটি খোঁড়া চলতে থাকে। কাজের বহর দেখে থমকে দাঁড়ান পথচলতি দু’একজন। হাসতে হাসতে জানতে চান, ‘কী হে, মিলল গুপ্তধন?’ রাগে গা-পিত্তি জ্বলে যায়। সবেতেই মশকরা! তবে হাল ছাড়ার পাত্র আমরা নই। জেদ আরও বেড়ে গেল। মনে মনে ভাবছি, একবার খুঁজে পায় ট্রেনের মাথা! তখন সব্বাইকে ডেকে তাক লাগিয়ে দেব।

আমি একটু উঠে বাড়ি ভিতরে গিয়েছিলাম। ফিরে এলাম ভাইয়ের ডাকে। সে তারস্বরে চিৎকার করছে, ‘দাদা, তাড়াতাড়ি আয়।’ ‘ইউরেকা’ বলে প্রায় লাফ দিয়ে গর্তের কাছে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম, ‘কী রে, দেখা গিয়েছে?’ চোখ কপালে তুলে ভাই বলল, ‘ওই দ্যাখ!’ যাহা দেখিলাম, জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না!

গর্ত থেকে মেট্রো নয়, হেলতে দুলতে উঠে আসছে বেআক্কেলে একটা কেঁচো! চমকে উঠলাম বাবার অট্টহাসিতে, ‘লোকে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে পায়। তোরা মেট্রো খুঁজতে কেঁচো পেলি!’ মনে হচ্ছিল, এমন অপমানিত হওয়ার থেকে ওই গর্ত দিয়ে পাতালে চলে যাওয়া ভাল। হাসতে হাসতে তখনও বাবা বলে চলেছে, ‘শোন, কলকাতায় মাটির তলায় মেট্রো চলে, গ্রামে চলে কেঁচো!’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Memory Nostalgia
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE