চলছে ভাইফোঁটা। নিজস্ব চিত্র
দ্বিতীয়ার সকাল। নবদ্বীপের রাধারমণ বাগ সমাজবাড়ির মূল মন্দিরের সামনে শ্বেতপাথরের অলিন্দে সাজানো হয়েছে বেদি। তাতে বিরাজ করছেন অষ্টসখী পরিবৃত রাধারানির মূর্তি। তাঁদের সাজ পোশাকে এ দিন মুক্তোর ছড়াছড়ি। হওয়াটাই স্বাভাবিক। বর্ষানার রাজা বৃষভানু এবং কীর্তিদার কন্যা রাধারানি এসেছেন একমাত্র ভাই শ্রীদামকে ফোঁটা দিতে। সঙ্গে আছেন ছোট বোন অনঙ্গমঞ্জরী এবং অন্য সখীরা। শ্বশুরবাড়ি জাবট থেকে আয়ান ঘরনি রাধা ভ্রাতৃদ্বিতীয়া উপলক্ষে বর্ষানা আসা ঘিরে চারিদিকে উৎসবের মেজাজ।
মাহেন্দ্রক্ষণের আগেই ডালা সাজিয়ে তৈরি সমাজবাড়ির সেবায়েত সাধুরা। তাঁদের কারও পরনে দামি সাদা জামদানি। কারও শাড়ি রঙিন ময়ূরকণ্ঠী। হাতে সোনার কাঁকন। ডান হাতে পিতলের রেকাবিতে চন্দন, কাজল, ধান, দুর্বা।
এক সময় মন্দির জুড়ে বেজে উঠল মৃদঙ্গ মন্দিরা শঙ্খ। বিশেষ কীর্তনের সঙ্গে শুরু হয়ে গেল ভ্রাতৃদ্বিতীয়ায় শতাব্দী প্রাচীন অনুষ্ঠান। প্রবীণ বৈষ্ণব রাধাপদ দাসের সুবর্ণবলয় শোভিত বাম হাতের বুড়ো আঙুল স্পর্শ করে আছে রাধারানির প্রাচীন বিগ্রহের অঙ্গ। আর কড়ে আঙুল দিয়ে কখনও চন্দন কখনও বা কাজলের ফোঁটা এঁকে দিচ্ছেন সামনের শ্রীদাম বিগ্রহের কপালে। প্রশস্ত বেদির উপরে শ্রীদাম বিগ্রহের কপালে একে একে ফোঁটা এঁকে দেন দুই দিদি-সহ অষ্টসখী। কিন্তু পাথুরে বিগ্রহ তো সত্যি করে ফোঁটা দিতে পারে না। তাই গোপী সাজে সজ্জিত মঠবাসী বৈষ্ণব সাধুরা ফোঁটাদানের কাজটি সম্পন্ন করেন।
শতাধিক বছর ধরে এ ভাবেই রাধারানির ভাইফোঁটা উদ্যাপিত হয় নবদ্বীপের রাধারমণ বাগ সমাজবাড়িতে। মঙ্গলকামনায় ভাইয়ের কপালে চন্দন, কাজলের ফোঁটা, কুনজর এড়াতে অঙ্গে লোহা স্পর্শ করিয়ে রাধারানি প্রথমেই ভাইয়ের হাতে তুলে দেন নিমপাতা। ঋতু পরিবর্তনের সময়কালীন রোগ প্রতিষেধক নিমের পর থরে থরে সাজিয়ে দেওয়া হল রকমারি মিষ্টি, ক্ষীর, পরমান্ন, খাজা, গজা, লাড্ডু, মোয়া সব শেষে পান।
ভাইফোঁটা ঘিরে এই ব্যতিক্রমী উৎসব প্রসঙ্গে রাধারমণ বাগ সমাজবাড়ির ব্যাখ্যায় মিশে আছে শ্রীমদ্ভাগবত এবং পুরাণ কাহিনী। কৃষ্ণ যখন গিরিগোবর্ধন আঙুলে ধারণ করে বৃন্দাবনের গোপদের উপর ইন্দ্রে আক্রমণ প্রতিহত করলেন এবং গিরিগোবর্ধন পুজোর সূচনা করলেন তখন রাধারানিও সেই পুজোয় যোগ দিতে এসে ছিলেন শ্বশুরবাড়ি থেকে। সেই উৎসব বা অন্নকূটের পরদিন ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। তিনি তাঁর একমাত্র ভাই কৃষ্ণসখা শ্রীদামকে ভাইফোঁটা দিয়ে ছিলেন বলেই ভক্তদের বিশ্বাস। সওয়া-শো বছর আগে পুরীতে রাধারানির এই লীলার স্মরণে ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার উৎসবের সূচনা করেন সমাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা দাদামশাই রাধারমণ দাস। উনিশ শতকের একেবারে গোঁড়ায় নবদ্বীপে মন্দির প্রতিষ্ঠার লগ্ন থেকেই দাদামশাইয়ের সার্থক উত্তরসাধক ললিতা সখী নবদ্বীপ ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার দিনে এই অনুষ্ঠান বহাল রাখেন।
উল্লেখ্য, বৈষ্ণবদের কৃষ্ণভজনার নানা পথের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা হল সখীভাবে শ্রীকৃষ্ণ ভজনা করা। ললিতা সখী যিনি ভক্তমহলে ‘সখী মা’ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন তিনি এই ধারার অন্যতম সিদ্ধসাধক। বলা হয় স্বয়ং চৈতন্যদেব ছিলেন এই রাধাভাবে কৃষ্ণভজনার অন্যতম পথ প্রদর্শক। বৈষ্ণব পরিমণ্ডলে তাঁকে বলা হয় রাধাকৃষ্ণের মিলিত তনু, ‘রাধাভাবদ্যুতি সুবলিত্যং কৃষ্ণস্বরূপম্’। সেই ভজন পদ্ধতি পরবর্তীকালে বৈষ্ণবের অনুসরণ করতে থাকেন। রাধারমণ বাগ সমাজবাড়িতে ‘অষ্টকালীন সেবা’ চালু আছে। এই উৎসব তারই অঙ্গ। বহুদূর থেকে ভক্তেরা আসেন রাধারানির ভাইফোঁটা দেখতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy