Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

লাল জলে জীবনসুধা আছে গো!

তাঁদের দেওয়ালে কখনও মাথা কুটে মরেনি রোগী, বরং দুঃস্থ পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফিজ দিতে গেলে পাল্টা ধমক খেতে হয়েছে। শুনতে হয়েছে, ‘ওষুধটা আমিই কিনে দেব’, সেই সব হারানো ‘দেবতা’দের স্মৃতি হাতড়াল আনন্দবাজারগনাইদের পাড়াতেই বাড়ি সুধাকৃষ্ণের ‘কম্পাউন্ডার’ লক্ষ্মীকান্ত গনাই-এর।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

অনল আবেদিন
বহরমপুর শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৯ ০৪:৩৬
Share: Save:

দেশ তখন স্বাধীন হয়নি। কালাজ্বর আর ম্যালেরিয়া আক্রান্ত বাংলা। গ্রামে তখন মোরাম বিছান রাস্তার কথা কষ্টকল্পনারও অতীত ছিল। ইসলামপুর, বালুমাটি, হিতানুর, সরসাবাদ, নওদাপাড়ার মতো গ্রামের কাদার রাস্তায় চলেছেন পরম বৈষ্ণব এক ‘সাহেব’। ঘোড়ার পিঠে আসীন নিষ্ঠাবান বৈষ্ণবের পরনে থাকত সাহেবি স্যুট। পায়ে হাঁটু সমান গামবুট। মাথায় সাহেবি টুপি। তিনি কিছুটা আড়াল হতেই শ্রদ্ধায় বিগলিত লোকজন গেয়ে উঠতেন, ‘‘সুধা ডাক্তারের তিতকুটে লালজলে জীবনসুধা আছে গো, জীবনসুধা!’’

ইসলামপুরের ওই চিকিৎসক দিন শুরু করতেন প্রতিবেশীদের বাড়ির শৌচালয় ও নিকাশিনালা সরেজমিনে দেখার পর পরিচ্ছনতার পরামর্শ দিয়ে। প্রায় শতবর্ষ পরে আজকের দিনে যাকে ‘গণস্বাস্থ্য চেতনা’ বলে। ওষুধ ও ‘ফিজ’ আট আনা নেওয়ার পরে রোগী ও তাঁর পরিজনদের তিনি বলতেন, ‘‘বাড়ির থালা-বাসন, রান্নাঘর, হাতমুখ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখলে কষ্টের এই আট আনা আমাকে দিতে হত না!’’

তাঁর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বিধানচন্দ্র রায়ের মতোই ‘মিথ’ হয়ে আছে চক-ইসলামপুর এলাকায়। তাঁর বাড়ি ইসলামপুরে। লাগোয়া চকে বাড়ি বর্ধিষ্ণু গনাই পরিবারের। সদ্যজাত শিশু কোলে বহরমপুর থেকে চকে ফিরছেন তাঁদের বাড়ির এক মহিলা। সুধাকৃষ্ণ দাসও বহরমপুর থেকে ওষুধ কিনে ইসলামপুরে ফিরছেন। কলাডাঙার ফেরিঘাটে নৌকায় ভৈরব নদী পার হওয়ার সময় তিনি গনাই বাড়ির প্রসূতিকে পর্যবেক্ষণ করেন।

গনাইদের পাড়াতেই বাড়ি সুধাকৃষ্ণের ‘কম্পাউন্ডার’ লক্ষ্মীকান্ত গনাই-এর। সন্ধ্যায় ‘চেম্বার’ বন্ধ করে লক্ষ্মী যাবেন চলে। সুধাকৃষ্ণের হাঁক, ‘‘লক্ষ্মী! এই ইঞ্জেকশন ও স্যালাইন তোর কাছে রাখ। দেখবি, রাতে গনাইদের বাড়ি থেকে ডাক পাবি। টিটেনাসের ওষুধগুলো দেওয়ার পরে আমাকে ডাকতে আসবি।’’ ঘটলও তাই। সারারাত রোগীর মাথার কাছে বসে থেকে সুধাকৃষ্ণ যমের হাত থেকে মহিলাকে ছিনিয়ে আনেন।

শতবর্ষ আগের গ্রাম জীবনের অসহায় মানুষদের চিকিৎসার জন্য মুদিখানার মালিক তিন সহোদর— শিবকৃষ্ণ, করুণাকৃষ্ণ ও কালীকৃষ্ণ সম্মিলীত ভাবে তাঁদের কনিষ্ঠ ভাই সুধাকে ডাক্তারি পড়ান। ১৯২৩ সালে এলএমএফ (লাইসেন্স অব মেডিক্যাল ফ্যাকালটি) পাশ করেন। দাদাদের স্বপ্নপূরণে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ব্রিটিশরাজের নির্দেশনামা। কালাজ্বর ও প্লেগ প্রতিরোধে বছর তিনেকের জন্য তাঁকে চলে যেতে হয় রেঙ্গুন।

সেখান থেকে ফিরে মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজের আরওএমও (রেসিডেন্সিয়াল মেডিক্যাল অফিসার) হওয়ার লোভনীয় ডাক পান। সুধাকৃষ্ণের নাতি ধীমান দাস বলেন, ‘‘এলাকার গরিব মানুষের চিকিৎসা করে ঠাকুর্দা তাঁর তিন দাদার স্বপ্নপূরণ করবেন বলে মাদ্রাজের লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন।’’ নামমাত্র ফিজে এলাকার প্রথম অ্যালাপাথিক চেম্বার খোলেন তিনি।

ইসলামপুর হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সোলেমান হক বলেন, ‘‘১৯৩৮ সালে ইসলামপুর হাইস্কুলের হীরকজয়ন্তীতে এসে মন্ত্রী হুমায়ুন কবীর, কবি কাজি নজরুল ইসলাম ও অন্নদাশঙ্কর রায় সুধা ডাক্তারের দাতব্য চিকিৎসালয়ের উদ্বোধন করেন।’’ ১৯৬৮ সালে রথের দিন সকালে তিনি মারা যান। দিনভ’র বিশ গ্রামের শোকাতুর লোক ভেঙে পড়ে তাঁদের জীবনসুধাকে শেষবিদায় জানাতে। চক-ইসলামপুরে সে দিন রথের রশিতে টান পড়েনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Health
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE