Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

শিশুশ্রম রুখতে কড়া পদক্ষেপের আশ্বাস

পিংলায় বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে মারা গিয়েছিল মুর্শিদাবাদের নয় কিশোর। শনিবার সরকারের তরফে নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সাহায্য তুলে দিতে সুতির চাঁদরা গ্রামে আসেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। এ দিন তিনি শিশু শ্রম বন্ধে রাজ্য এ বার থেকে আরও কড়া হবে বলে জানান। তাঁর কথায়, ‘‘রাজ্যে শিশু শ্রম বন্ধে কড়া পদক্ষেপ করার কথা ভাবছে রাজ্য সরকার। এর জন্য জেলার শ্রম ও শিশু কল্যাণ দফতরগুলিকে আরও সক্রিয় করা হবে।’’

সুতির নতুন চাঁদরা গ্রামে তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়

সুতির নতুন চাঁদরা গ্রামে তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়

বিমান হাজরা
অরঙ্গাবাদ শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৫ ০১:০০
Share: Save:

পিংলায় বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে মারা গিয়েছিল মুর্শিদাবাদের নয় কিশোর। শনিবার সরকারের তরফে নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সাহায্য তুলে দিতে সুতির চাঁদরা গ্রামে আসেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। এ দিন তিনি শিশু শ্রম বন্ধে রাজ্য এ বার থেকে আরও কড়া হবে বলে জানান। তাঁর কথায়, ‘‘রাজ্যে শিশু শ্রম বন্ধে কড়া পদক্ষেপ করার কথা ভাবছে রাজ্য সরকার। এর জন্য জেলার শ্রম ও শিশু কল্যাণ দফতরগুলিকে আরও সক্রিয় করা হবে।’’
বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ বেআব্রু করে দিয়েছে মুর্শিদাবাদের শিশু শ্রমের বিষয়টি। চলতি মাসের ৬ তারিখের ওই বিস্ফোরণে মৃত ১২ জনের মধ্যে ৯ জনেরই বাড়ি মুর্শিদাবাদের সুতি থানার নতুন চাঁদরা গ্রামে। মৃত মধ্যে আটজনই নাবালক ছিল। থাকা-খাওয়া সহ মোটা টাকা মজুরি দেওয়ার লোভ দেখিয়ে তাদের পিংলায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মন্ত্রী বলেন, ‘‘সুতি এলাকায় বহু মানুষ বিড়ি বাধা সহ বিভিন্ন পেশার সঙ্গে জড়িত। এই সমস্ত কাজ অনেক শিশুও করছে। শিশুদের ভুল বুঝিয়ে নিয়ে গিয়ে পিংলায় অবৈধ বাজি কারখানায় কাজে লাগানো হয়েছিল। যারা ওই বিস্ফোরণের সঙ্গে জড়িত তাদের কাউকে ছাড়া হবে না।’’

যে সমস্ত পরিবারের হাতে এ দিন চেক তুলে দেওয়া হয় তাদের কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন মাত্র ২ লক্ষ টাকার সাহায্যে কী আর হবে? মৃত এক কিশোরের মায়ের কথা, ‘‘আজ সরকার পাশে দাঁড়াচ্ছে। কারণ, গ্রামের অসহায় মানুষগুলোর কথা দেরিতে হলেও বুঝেছে। বিডিও, এসডিও থেকে মন্ত্রী সকলেই গ্রামে এসেছেন। কিন্তু গ্রামের ৯ জন কিশোরের মৃত্যুর ঘটনার দিন থেকে এক সপ্তাহ গ্রামে রাজনীতির নেতা থেকে শুরু করে প্রশাসনের কেউ আসেননি।’’ মৃত্যুর বিনিময়ে ক্ষতিপূরণ তো মিলল, কিন্তু আমাদের কি হবে? – প্রশ্নটা দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র নতুন চাঁদরার বাবু শেখের। সে বলে, ‘‘বিজ্ঞান নিয়ে আগামী বছর উচ্চ মাধ্যমিক দেব। ইচ্ছে ছিল, আরও পড়াশুনো করার। কিন্তু তা আর হবে না। বৃদ্ধ বাবা আর কাজে যেতে পারেন না। মা বিড়ি বাঁধেন, তাতে কী আর সংসার চলে? তাই উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েই রাজমিস্ত্রির কাজে চলে যাওয়া ছাড়া কোনও পথ খোলা নেই আমার সামনে। গ্রামে আমাদের মত বহু ছেলেরই একই অবস্থা। তাই ক্ষতিপূরণের চেয়েও জরুরি উচ্চ শিক্ষার সুযোগ।’’

ঠিক ছিল মন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির সঙ্গে কথা বলবেন। কিন্তু প্রচন্ড বৃষ্টির জন্য কোনওরকমে অনুষ্ঠান শেষ করে দেওয়া হয়। ফলে ফলে মন্ত্রী নিহতদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে পারেননি।

চাঁদরা শিশু শ্রমের আঁতুড় ঘর। গ্রামে ১২০টি পরিবারের মধ্যে প্রতিটি ঘরে ঘরে ১০ থেকে ১৪ বছরের শতাধিক কিশোর শ্রমিক হিসেবে কখনও যায় রাজমিস্ত্রির কাজে, কখনও বা অন্য কাজে। অভাবের সংসারে যখন বিড়ি বেঁধেও পেট চলে না, তখন এই কিশোররা শ্রমিক হিসেবে বাজি তৈরির কাজে যাচ্ছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। মন্ত্রী বলেন, ‘‘বর্তমান বাজারে মাত্র ২ লক্ষ টাকা খুব বড় কিছু নয়। টাকা দিয়েও আপনাদের ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়। তবে এই গ্রামে যাতে আর কেউ এই ভাবে মারা না যায় তার জন্য রাজ্য সরকার কিছু ব্যবস্থা নেবে। এই গ্রামের উন্নয়নে কী করা যায়, সেটাও দেখা হচ্ছে।’’

জেলা শিশু কল্যাণ দফতরও মানছে জেলাজুড়ে চলতে থাকা শিশু শ্রমিকদের রমরমার কথা। কিন্তু তাদের যে কোনও হেলদোল নেই নতুন চাঁদরার ঘটনা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। শিশুদের যে বাজি তৈরির মত ঝুঁকিপূর্ণ কাজেও লাগানো হচ্ছে তাও স্পষ্ট করে দিয়েছে। সুতি-২ ব্লকের শিশু সুরক্ষা বিষয়ক কমিটির প্রধান ও পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি আনিকুল ইসলাম বলেন, ‘‘এলাকার প্রধান সমস্যা অশিক্ষা। শিশু শ্রম বন্ধের বিষয়ে তাই সচেতনতার অভাব রয়েছে। এই ঘটনার পর বিডিও সহ প্রশাসনিক কর্তাদের বার বার বলা সত্ত্বেও গ্রামে যাননি তাঁরা। শিশুদের সুরক্ষা নিয়ে যে কমিটি রয়েছে প্রতি ব্লকে তারাও সক্রিয় নয়। শিশু শ্রম বন্ধের ব্যাপারে যাদের সবচেয়ে বেশি তৎপর হওয়া উচিত ছিল সেই শ্রম ও শিশু কল্যাণ দফতরও উদাসীন। অতি দরিদ্র এই এলাকায় ১০ থেকে ১৪ বছরের কিশোরেরা কেউ বিড়ি কারখানায়, না হয় কেউ রাজমিস্ত্রীর কাজ করে।’’ জেলার শিশু সুরক্ষা কমিটির সহ আধিকারিক মহম্মদ নুর ইসলাম নিজে হাজির ছিলেন এ দিনের অনুষ্ঠানে। তিনি বলেন, ‘‘শিশুশ্রম মুর্শিদাবাদ জেলার সুতি এলাকার একটা বড় সমস্যা। বেশি পয়সার লোভ দেখিয়ে শিশুদের বাইরে কাজে নিয়ে যাওয়া হয়। এ নিয়ে শিশু কল্যাণ দফতর কিছু কর্মসূচী নিয়েছে। নতুন চাঁদরা সহ সুতির গ্রামগুলিতে সমীক্ষার কাজ শুরু করে শিশু শ্রমিকদের চিহ্নিত করার কাজ শুরু করা হচ্ছে। ২৩ মে ওই এলাকায় যাবেন রাজ্য শিশু কল্যাণ দফতরের কর্তারা । কীভাবে সেখানে শিশুশ্রম মোকাবিলা করা যায় তা নিয়ে ভাবনা চিন্তা চলছে।’’

এলাকার বিধায়ক তৃণমূলের ইমানি বিশ্বাস, চাঁদ মহম্মদ, সুব্রত সাহা, মান্নান হোসেন-সহ তৃণমূলের নেতারা এ দিনের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE