Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

জীবনটাই ওরা শেষ করে দিল

খানিকটা দূরেই বাড়ি অনিল বিশ্বাসের। তাঁকে আর হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। কালনার রাস্তায় গণপিটুনি খেয়ে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। মারধরে মারাত্মক জখম হয়েছিলেন আরও তিন জন। তাঁদের কারও কান কেটে গিয়েছে, কারও পায়ে এমন চোট যে বাইরে বেরোতে হলে বাড়ির লোক সঙ্গে থাকতে হয়। 

ভেঙে পড়েছেন নিহত নারায়ণ দাসের স্ত্রী ও মা। ছবি: প্রণব দেবনাথ

ভেঙে পড়েছেন নিহত নারায়ণ দাসের স্ত্রী ও মা। ছবি: প্রণব দেবনাথ

সৌমিত্র সিকদার
হবিবপুর শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০১৯ ০৫:৩৬
Share: Save:

ছেলেকে বাঁচানোর জন্য নিজের যা কিছু টাকা ছিল সব ঢেলে দিয়েছিলেন। শেষে বাড়ি-বাড়ি ভিক্ষা করেছিলেন। তাঁর জন্য পাড়ার লোকেরাও টাকা তুলতে ছিলেন। কিন্তু বাঁচানো যায়নি । গণপিটুনির ন’দিন পরে কলকাতায় এসএসকেএম হাসপাতালে লড়াই শেষ হয়ে যায় হবিবপুরের নারায়ণ ওরফে সমর সরকারের।

খানিকটা দূরেই বাড়ি অনিল বিশ্বাসের। তাঁকে আর হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। কালনার রাস্তায় গণপিটুনি খেয়ে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। মারধরে মারাত্মক জখম হয়েছিলেন আরও তিন জন। তাঁদের কারও কান কেটে গিয়েছে, কারও পায়ে এমন চোট যে বাইরে বেরোতে হলে বাড়ির লোক সঙ্গে থাকতে হয়।
২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি সকালে রানাঘাটের ওই এলাকা থেকে পূর্ব বর্ধমানের কালনায় গাছে কীটনাশক ছড়ানোর কাজ করতে যান পাঁচ জন। তার আগে থেকেই সেখানে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা গুজব ছড়ানো হচ্ছিল। ছেলেধরা সন্দেহে পাঁচ জনকে ঘিরে ফেলা হয়। তার পর শুরু হয় মার। নিহত ও আহতদের পরিবার ও গ্রামের লোকজন অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাইছেন।

সমরের বাবা শিবু দাস বলেন, ‘‘ছেলেকে বাঁচাতে ভিক্ষা পর্যন্ত করেছি। কিন্তু ফেরাতে পারলাম না।’’ সমরের স্ত্রী তারামণি বলেন, “আমার তো সব গিয়েছে। এক মাত্র ছেলেকে ঠিক মতো লেখাপড়া করাতে পারছি না। একটা কাজও পেলাম না। কী দোষ ছিল আমার স্বামীর? যারা ওকে মেরেছে, তাদের চরম শাস্তি চাই। আর কেউ যেন এমন নৃশংস কাজ করার সাহস না পায়!’’

নিহত অনিল বিশ্বাস (বাঁ দিকে) ও নারায়ণ দাস ( ডান দিকে)। নিজস্ব চিত্র

অনিলের চার ছেলে, এক মেয়ে। ছেলেদের মধ্যে এক জন গাছে ওষুধ দেওয়ার কাজ করেন। বাকিরা অন্য পেশায় যুক্ত। অনিলের কথা উঠতেই কেঁদে ফেলেন তাঁর অশীতিপর মা। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে অনিলের স্ত্রী লক্ষ্মী বলেন, “বেশির ভাগ দিন দুপুরের পর ও বাড়ি আসত। সে দিন ওর মৃত্যুসংবাদ এল।’’ তাঁরাও চাইছেন, দোষীদের চরম শাস্তি।
সে দিন প্রাণে বেঁচে গেলেও কার্যত অক্ষম হয়ে দিন কাটাচ্ছেন হবিবপুর রাঘবপুর মাঠপাড়ার ব্যঞ্জন বিশ্বাস। এখন তিনি বাড়িতে বসে তাঁত চালান। ভাল চলতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘‘বারবার বলেছিলাম, ছেলেধরা নই। আমাদের কাছে সব কাগজ রয়েছে। ওরা শোনেনি। মারে জ্ঞান হারিয়েছিলাম। বুকের হাড় ভেঙে কিডনিতে বসে গিয়েছিল। পায়ে চোট। চলতে কষ্ট হয়।”

অপরাধী ১২

তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, সমরেশ হালদার, গণেশ দাস, তাপস রায় ওরফে পাখি, নাজির শেখ, বাবু সরকার, প্রীতম কর্মকার, রাজু পাত্র, কুন্তল দেবনাথ, মিনতি হালদার, সুমন পাত্র ওরফে কানু এবং সাগর বাছার।

দুই মৃতের পরিবার রাজ্য সরকারের থেকে দু’লক্ষ টাকা করে পেয়েছে। আহতেরা কিছুই পাননি। ব্যঞ্জনের স্ত্রী মীরা বলেন, “সরকার ৫০ হাজার টাকা দেবে শুনেছিলাম। কোথায় কী? টাকার অভাবে বড় ছেলের লেখাপড়া মাঝপথে বন্ধ করে দিতে হল।” একা চলাফেরা করতে পারেন না রায়পাড়ার মানিক সরকার। তাঁর ডান পা জখম, বাঁ কান কেটে গিয়েছে। তাঁর স্ত্রী ঘরের লাগোয়া চায়ের দোকান চালাচ্ছেন। তাঁর স্ত্রী সীমা বলেন, ‘‘টাকার অভাবে এক মাত্র ছেলেকে উচ্চ মাধ্যমিকের পরে আর লেখাপড়া করাতে পারিনি।”

পনেরো বছরেরও বেশি ধরে ওষুধ ছড়ানোর কাজ করেছেন দেবীপুরের মধুমঙ্গল তরফদার। তার ডান চোখে চোট। এখন তিনি রানাঘাট আদালতে মুহুরির কাজ করেন। তিনি বলেন, “ওরা যখন আমাদের মারছে, কেউ ঠেকাতে আসেনি। বলেছিলাম, চাইলে আমাদের পুলিশের হাতে তুলে দিন। তা-ও করল না। ওই দিন বিকাল ৫টায় আমার জ্ঞান ফিরেছিল। দেখি, আদালত ওদের কী সাজা দেয়।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Maldaha Habibpur Lynching
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE