শান্তিপুরে উল্টোরথ। নিজস্ব চিত্র
জগন্নাথদেবের পুনর্যাত্রা বা উল্টোরথের রশি ধরে স্মার্ত মত এবং উৎকল মতের টানাটানির জেরে পঞ্জিকা নির্দিষ্ট তারিখে সর্বত্র গড়াল না উল্টোরথের চাকা। অধিকাংশ পঞ্জিকা কিংবা ক্যালেন্ডারে বৃহস্পতিবার উল্টোরথ বলে সুস্পষ্ট ভাবে বলা হলেও খোদ জগন্নাথ ধাম পুরী কিংবা চৈতন্যধাম নবদ্বীপে এ দিন উল্টোরথ পালিত হল না। পরিবর্তে আজ, শুক্রবার উল্টোরথে চড়ে মাসির বাড়ি থেকে পুনর্যাত্রা করবেন জগন্নাথদেব। আবার অদ্বৈতধাম শান্তিপুর কিংবা কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে বৃহস্পতিবারেই হল উল্টোরথ।
উল্টোরথের দিনক্ষণ নিয়ে এই দড়ি টানাটানির পিছনে রয়েছে স্মার্ত এবং উৎকল এই দুই পঞ্জিকার মত পার্থক্য। যেমন, স্মার্ত মতের অনুসারী বিশুদ্ধ সিধান্ত পঞ্জিকা মতে ১৪২৬ সনের শ্রীশ্রীজগন্নাথ দেবের পুনর্যাত্রা বা উল্টোরথ ২৬ আষাঢ় ১৪২৬ বৃহস্পতিবার। ইংরাজির ১১ জুলাই ২০১৯। প্রচলিত বাংলা ক্যালেন্ডারের অধিকাংশ এই মত অনুসরণে বৃহস্পতিবার উল্টোরথ বলে চিহ্নিত করেছে। তবুও বৃহস্পতিবার পুরী -সহ বহু জায়গায় উল্টোরথের চাকা ঘুরল না। কারণ উৎকল বা ওড়িশার মতে উল্টোরথ ২৭ আষাঢ় ১৪২৬ শুক্রবার, ইংরাজি ১২ জুলাই ২০১৯। যেহেতু পুরীধামে জগন্নাথদেবের পুনর্যাত্রা উৎকল মতে শুক্রবার অনুষ্ঠিত হবে। তাই দেশের একটা বড় অংশে উল্টোরথ আজ, শুক্রবার পালিত হবে।
বিধি মেনে পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রা প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়। এবং শুক্লা একাদশীতে উল্টোরথ বা জগন্নাথ দেবের পুনর্যাত্রা হয়। উল্টোরথ ঘিরে স্মার্ত এবং উৎকল মতের ফারাক প্রসঙ্গে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিবেকবন্ধু ব্রহ্মচারী। তিনি সুদীর্ঘ কাল পুরী মন্দিরে ছিলেন। তিনি জানান, পুরীধাম হল শ্রীক্ষেত্র। শ্রী অর্থে লক্ষী। তাই এই ধাম হল লক্ষ্মীর ক্ষেত্র। সম্পদের ভূমি। বৃহস্পতিবারও লক্ষ্মীবার বলে ভক্তজনের কাছে পরিচিত। উৎকল বা শ্রীক্ষেত্রের প্রচলিত বিধি মেনে বৃহস্পতিবারে ক্ষেত্রত্যাগ করা যায় না। গমন, প্রত্যাগমন কোনটিই নয়। তাই বৃহস্পতিবারে উল্টোরথ হলে জগন্নাথদেব মন্দিরে প্রবেশ করতে পারতেন না। সে কারণেই স্মার্ত মতের সঙ্গে উৎকল মতের এই পার্থক্য এ বার তৈরি হয়েছে।
কিন্তু স্মার্ত রঘুনন্দনের নিজভূমি নবদ্বীপ কেন উৎকল মতে উল্টোরথের নির্ঘণ্ট অনুসরণ করছে? জবাবে নবদ্বীপের শাস্ত্রজ্ঞ মহলের ব্যাখ্যা, নবদ্বীপের রথে চৈতন্যপ্রভাব জগন্নাথের থেকে বেশি। মহাপ্রভু জগন্নাথের একনিষ্ঠ সেবক বলতেন নিজেকে। পুরীর রথযাত্রা ছিল তাঁর বড় প্রিয়। তিনি অপ্রকট হওয়ার পর নবদ্বীপ জুড়ে নেমে এসেছিল গভীর বিষাদ। সেই বিরহের পরিমণ্ডলে তাঁর প্রিয় কাজগুলি অনুসরণের মাধ্যমে তাঁকে ছুঁতে চেয়েছিল সেকালের মানুষ। তাঁর ভক্তেরা। নবদ্বীপের রথের যাত্রা শুরু এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। তাই এখানে রথযাত্রায় পুরীর রীতিনীতি প্রাধান্য পাবে এটাই স্বাভাবিক।
অন্য দিকে, শান্তিপুরের বড় গোস্বামী বাড়ি থেকে শুরু করে সমস্ত বিগ্রহ বাড়িতে বৃহস্পতিবার উল্টোরথ উদ্যাপন করা হয়েছে। এই বিষয়ে বড় গোস্বামী বাড়ির সত্যনারায়ণ গোস্বামী জানান, “যে দিনের সূর্যোদয়ে তিথি শেষ হচ্ছে সেই দিনটি ধরে আমাদের এখানে সমস্ত উৎসব পালন করা হয়। উল্টোরথ হয় আষাঢ়ের শুক্লা দশমীতে। বৃহস্পতিবার রাতে দশমী ছেড়ে যাচ্ছে। তাই শান্তিপুরে বৃহস্পতিবার উল্টোরথ হয়েছে।” একই কথা বলেন শান্তিপুর সাহা বাড়ির রথের অন্যতম উদ্যোক্তা জহরলাল সাহা।
সুপ্রাচীন কাল থেকে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির দুর্গাপুজো সূচনা হয় উল্টোরথের দিন পাটপুজোর মধ্যে দিয়ে। সেই রীতি মেনে বৃহস্পতিবার উল্টোরথ ধরে সূচনা হল রাজরাজেশ্বরী পুজোর। এই প্রসঙ্গে নদিয়া রাজ পরিবারের প্রধান সৌমীশচন্দ্র রায় বলেন, “পঞ্জিকা মতে বৃহস্পতিবার উল্টোরথ। তাই প্রথা মেনে এদিন রাজবাড়িতে পাটপুজো হয়েছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy