Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

যে বিয়েতে পদ্য নেই, সে আবার বিয়ে!

একটা সময় ছিল, যখন অনেক সম্পন্ন হিন্দু বাঙালি পরিবারে বিয়ের অনুষ্ঠান পদ্য ছাড়া ভাবা যেত না। পাতলা রঙিন কাগজে অখ্যাত লেটার প্রেসে ছাপা হলদে-গোলাপি রুমাল পদ্য অভ্যাগতদের হাতে-হাতে ঘুরত। গায়ে তার ছাপাখানার কালির কাঁচা গন্ধ।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:৫১
Share: Save:

কথায় বলে— ‘যে পাখির লেজ নেই সে আবার টিয়ে, যে বিয়েতে পদ্য নেই সে আবার বিয়ে! ’

এখন আর তেমন না বললেও এক সময়ে বলত। একটা সময় ছিল, যখন অনেক সম্পন্ন হিন্দু বাঙালি পরিবারে বিয়ের অনুষ্ঠান পদ্য ছাড়া ভাবা যেত না। পাতলা রঙিন কাগজে অখ্যাত লেটার প্রেসে ছাপা হলদে-গোলাপি রুমাল পদ্য অভ্যাগতদের হাতে-হাতে ঘুরত। গায়ে তার ছাপাখানার কালির কাঁচা গন্ধ। সাহিত্যমূল্য তেমন না থাকলেও বিয়ের রাতে বরপক্ষ ও কনেপক্ষ সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্য নিমন্ত্রিতদের কাছে পৌঁছে যেত পদ্য মারফত। ভোজের পাতে কখন কী পড়বে, তার হদিসও মিলত।

কবে থেকে এই চল শুরু হল, তা বিশেষ স্পষ্ট নয়। এক সময়ে দিদিমা-ঠাকুমারা স্মৃতি থেকেই বলে যেতেন, ‘ফুটিতেছিল দু’টি ফুল জগত কাননে, মিলে গেল আজ এই তেসরা শ্রাবণে’ বা ‘পটবাস পরিধানে হাসিমাখা আননে, আনিবার তরে ঘরে জীবনসঙ্গিনী। মুকুট শোভিত শিরে চলিছ ধীরে ধীরে, প্রতীক্ষিয়া তব তরে ফুল রথখানি।’

উনবিংশ শতকে দেশে ছাপাখানা আসামাত্র শ্রুতি ও স্মৃতিকে ছাপার অক্ষরে গেঁথে ফেলা শুরু হল। বিগত শতকের ষাটের দশক পর্যন্ত দারুণ জনপ্রিয়তা ছিল এই সব পদ্যের। রবীন্দ্রনাথ থেকে দ্বিজেন্দ্রলাল, অমৃতলাল বসু থেকে গিরিশ ঘোষ, এমনকী প্রেমেন্দ্র মিত্র পর্যন্ত বিয়ের পদ্য লিখেছেন। তবে সংখ্যায় এগিয়ে রবীন্দ্রনাথই। ঘনিষ্ঠ বন্ধু-পরিজনদের বিয়েতে তাঁর তরফ থেকে উপহার যেত কবিতা।

লালগোলার রাজা যোগীন্দ্রনাথ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বন্ধুস্থানীয়। তাঁর বিয়েতে কবি লেখেন, ‘তোমাদের যে মিলন হবে, বিয়ের হল জানাজানি। তারাগুলি করছে কেবল, হাসাহাসি কানাকানি। রাত্রি যখন গভীর হবে, বাসরঘরের বাতায়নে। মারবে ওরা উঁকিঝুঁকি, এইটে ওদের আছে মনে।’ ত্রিপুরার রাজকুমার রমেন্দ্রকিশোর দেববর্মার সঙ্গে কোচবিহারের রাজকন্যা ইলাদেবীর বিয়েতেও তিনি উপহার দিয়েছিলেন। সুরেন ঠাকুরের কন্যা জয়শ্রীর বিয়েতে লিখলেন, “তোমাদের বিয়ে হল ফাগুনের চৌঠা, অক্ষয় হয়ে থাক সিঁদুরের কৌটা। সাত চড়ে কভু যেন কথা মুখে না ফোটে, নাসিকার ডগা ছেড়ে ঘোমটাও না ওঠে।’ নিতান্তই হালকা চালে লেখা!

সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজও বিয়ের পদ্য নিয়ে ভারী খুঁতখুঁতে। পদ্য যাতে সঠিক বানানে নির্ভুল ছাপা হয়, তার জন্য নিজে প্রুফ দেখতেন। ভাই বা অন্য পরিচিতদের জন্য বিয়ের পদ্য লিখেছেন তিনি। পরিবার প্রধান গুরুগম্ভীর পদ্যে আশীর্বাদ করতেন নবদম্পতিকে—‘‘সংসার সমুদ্র বড় ঝটিকাচঞ্চল, নিষ্কম্প সুস্থির লক্ষ্য সংহত নির্ভীক। থেকো বাছা দু’টি প্রাণ একাত্ম অটল, মঙ্গলময় বিধি আশীর্বাদ দিক।’’

জনতার হাতে পড়ে সেই পদ্যেরই লঘু চাল। যেমন— ‘আয় চাঁদ আয় না, পরছে কাকি গয়না। আয়রে আয় বিয়ে, ছাদনাতলা দিয়ে। ফলার খেতে সালার, চলল কাকু এ বার। সঙ্গে যাবে কে? ভাইপো-ভাইঝিরা ছিল, তারাই সেজেছে।’ দেওরের বিয়েতে বৌদির সরস দু’কলি— “বৈশাখের এ রোদ্দুরেতে পালা করলাম ভঙ্গ, ভুলো না ভাই মোদের যেন পেয়ে প্রিয়ার সঙ্গ। রঙ্গরসের চচ্চড়িতে খুব হয়েছে খাটনি, অবশেষে দিলুম পাতে কচি আমের চাটনি।”

যত্নে লেখা রুমাল-পদ্যের ফের দেখা মিলছে বিয়েবাড়িতে। কিছু দিন আগেই শান্তিপুরে পার্থ আর শ্রীপর্ণার বিয়েতে মামি-মাসিরা লিখেছেন, “ভাগ্নে তুমি তলে-তলে ভাসলে শেষে অথৈ জলে। প্রেমের জলে দিক হারালে, শালিপুরে মন ডোবালে!”

(তথ্য: দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভাশিস সৈয়দ ও অনল আবেদিন)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Marriage Ceremony Invitation Cards Poem
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE