সেপটিক-ট্যাঙ্ক: এখান থেকেই উদ্ধার করা হয় তিন জনের দেহ। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
সেপটিক ট্যাঙ্কের ভিতরে ছটফট করছে এক তরুণ। আর্তনাদ শুনে নেমে পড়েন আরও এক জন। ভিতর থেকে কোনও রকমে বলেছিল, ‘‘দমবন্ধ হয়ে আসছে, বাঁচাও গো।’’
রবিবার সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ চাপড়ার পোস্টঅফিস পাড়ায় রঞ্জিত সিংহ যাদবের বাড়িতে উপচে পড়েছে ভিড়। সকলেই অসহায় ভাবে ছোটাছুটি করছেন, চিৎকার করছেন। কেউ খুঁজছেন দড়ি। যাতে সেটা সেপটিক ট্যাঙ্কে নামিয়ে দিয়ে ওই দু’জনকে তুলে আনা যায়।
ঠিক সেই সময় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন এক প্রৌঢ়। তাঁর মোবাইলটা এক জনকে ধরতে দিয়ে তিনিও নেমে পড়েন ট্যাঙ্কের ভিতরে। পড়ে থাকা এক কিশোরকে কোনও রকম টেনে তোলার চেষ্টা করছিলেন। এক সময় তিনিও টলে পড়লেন সেই যুবকের বুকের উপরে। পা দুটো সামান্য নড়ে উঠেছিল। তারপর আর সাড়া নেই।
শেষতক বহু চেষ্টা করে সেপটিক ট্যাঙ্কের দেওয়াল ভেঙে তাদের উদ্ধার করে চাপড়া গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকেরা মারফত মল্লিক (১৮), ফারুক মণ্ডল (১৭) ও হাকিম মণ্ডলকে (৫০) মৃত বলে জানিয়ে দেন। তিন জনেই চাপড়ার পুরাতন পীতম্বরপুরের বাসিন্দা।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ফারুক ও মারফত দু’জনেই পোস্টঅফিসপাড়ায় রঞ্জিতবাবুর বাড়ি বেশ কিছু দিন ধরে আরও কয়েক জনের সঙ্গে রাজমিস্ত্রির কাজ করছিল। নির্মীয়মাণ ওই বাড়িতে ২১ দিন আগে সেপটিক ট্যাঙ্ক তৈরি করা হয়েছে। উপরটা বালি-সিমেন্টের ছাদ করা। মাঝখানে গোলাকার ফাঁক। সেটাও এত দিন ঢাকনা দিয়ে ঢাকা ছিল।
এ দিন সকালে ঢাকনা খুলে প্রথমে মারফত সেই ফাঁকা অংশ দিয়ে ভিতরে ঢোকে কাঠ আর বাঁশ খোলার জন্য। তাকে ভিতরে অসুস্থ হয়ে পড়তে দেখে নেমে পড়ে ফারুকও। অসুস্থ হয়ে পড়ে সে-ও। বিষয়টি নজরে আসতেই অন্য মিস্ত্রিরা ছুটে আসেন। কিন্তু দু’জনেই এ ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় বিপদ আন্দাজ করে ফেলেন অভিজ্ঞ রাজমিস্ত্রিরা। তাঁদের চিৎকারে ছুটে আসেন স্থানীয় বাসিন্দরা।
সকলেই অসহায়ের মতো ভিড় করে আছেন সেপটিক ট্যাঙ্কের উপরে। সেই সময় ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসেন আব্দুল হাকিম মণ্ডল। অনেকেই তাঁকে বাধা দেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, কারাও কথা না শুনে তিনি শুধু বলেন, ‘গ্রামের দু’টো ছেলে এ ভাবে মারা যাচ্ছে। আর সেটা আমি দাঁড়িয়ে দেখব নাকি?’ কোমরের সঙ্গে লুঙ্গিটা ভাল করে বেঁধে নেমে পড়েন নীচে।
ছুটে আসে চাপড়া থানার পুলিশ। এরই মধ্যে নিয়ে আসা হয় বড় বড় দুটো হাতুড়ি। ট্যাঙ্কের দেওয়াল ভেঙে তিন জনকে উদ্ধার করা হয়। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। ফারুকের জেঠা আবুলউদ্দিন মণ্ডল ও মারফতের কাকা মুরাদ আলি মণ্ডল জানান, অভাবের কারণেই স্কুল ছেড়ে দু’জনেই রাজমিস্ত্রির কাজ করত। সেপটিক ট্যাঙ্কে নামলে যে বিপদ হতে পারে তা তো ওদের জানার কথা। তার পরেও এ ভাবে নেমে পড়ল কেন, অন্যেরা বাধাই বা দিল না কেন সেটাই বোঝা যাচ্ছে না। হাকিমের ভাগ্নে সইফুল ইসলামের কথায়, ‘‘কারও বিপদ হলে স্থির থাকতে পারত না। এ বারেও সেই বিপদে ঝাঁপ দিয়ে নিজেই আর উঠতে পারল না।’’ প্রাথমিক ভাবে হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, সেপটিক ট্যাঙ্কের বিষাক্ত গ্যাসে মৃত্যু হয়েছে ওই তিন জনের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy