ব্যবসা: গলাকাটা অবস্থায় আসছে ভড়ুই পাখি। নিজস্ব চিত্র
মোবাইল ফোনে রিং হচ্ছে।
—‘মাল আছে?’
উল্টো দিক থেকে ফ্যাসফ্যাসে গলা বলল, ‘আসছে। এখন বাসে আছি। ফিরে দিচ্ছি। ক’টা লাগবে?’
— ‘৩০টা দিও। কোথায় এখন?’
— ‘বেথুয়া ছাড়াল। বাসে আছি। আজ দর ৭০০ টাকায় ২০টা। কিন্তু এ ভাবে বেশি কথা বলা যাবে না। গিয়ে ফোন করছি।’
ফোন কেটে যায়।
ঘণ্টা দুয়েক পরে প্লাস্টিকের প্যাকেটে চলে আসে বরফ-ঠান্ডা ৩০টা পালক আর ছাল ছড়ানো ভড়ুই পাখি। বুধবার, কৃষ্ণনগরে।
ছোট্ট পাখি ভড়ুই মেরে খাওয়া নিষিদ্ধ বহু দিন। কিন্তু কৃষ্ণনগরে বসে তা পাওয়া কোনও ব্যাপারই নয়। শুধু ঠিক লোককে জানতে হবে আর ট্যাঁকের জোর থাকতে হবে। ফোনে-ফোনে হোম ডেলিভারি হয়ে যাবে ভড়ুইয়ের মাংস।
যে কোনও দিন গোয়ারিবাজার বা পাত্রবাজারে মুরগি বা খাসির দোকান থেকে ফেরার পথে আপনার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কেউ জিজ্ঞেস করতেই পারে, ‘ভড়ুই লাগবে?’ সম্মতি দিলে বাড়িতে চলে আসবে মাংস।
যাঁরা এই কারবার চালাচ্ছেন, তাঁদের দাবি, প্রতি দিন কৃষ্ণনগরে প্রায় দু’হাজার কাটা ভড়ুই ঢোকে। বিক্রিও হয়ে যায়। ভড়ুই আসার পথ দুটো। এক) মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা থেকে বাসে জাতীয় সড়ক ধরে সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে ঢুকে যায় কৃষ্ণনগরে। দুই) বোলপুরের দিক থেকে কাটোয়া ঘাট পেরিয়ে কালীগঞ্জ হয়ে বেথুয়াডহরি দিয়ে বাসে। শহরে ঢুকতে প্রায় সাড়ে ১১টা বাজে। গলা কাটা অবস্থায় ছোট্ট পাখিগুলো বাসে করেই নিয়ে আসেন বিক্রেতারা। তার পর বাড়িতে পাখা চালিয়ে মাংসে কিছুক্ষণ হাওয়া দিয়ে ডিপ ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখেন। আধ ঘণ্টা পরে পালক ও ছাল ছাড়িয়ে অর্ডার মাফিক বাড়ি-বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়। মুরগির মাংস যেখানে ২০০ টাকা কেজি। সেখানে ২০টা ভড়ুইয়ে মাংস (মোট ওজন ৩০০ গ্রামের মতো) ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা।
এত দামি মাংসের ক্রেতা কারা? কারবারিরা বলছেন, বেশির ভাগই ‘রেগুলার কাস্টমার’। এক কারবারির দাবি, ‘‘শহরের বড়-বড় প্রোমোটার, ব্যবসায়ী, ডাক্তার, পুলিশ— খদ্দেরের তালিকায় কে নেই বলুন তো!’’
বছর কুড়ি আগে চৈত্রে কৃষ্ণনগরের ফোয়ারার মোড়ে, পাত্রবাজারের মুখে ঝুড়ি করে প্রকাশ্যেই জলের দরে বিক্রি হতো ভড়ুই পাখির মাংস। শহরের এক এক রিকশাচালকের কথায়, ‘‘এক সময়ে কত খেয়েছি! সামান্য দাম ছিল। এখন তো বড়লোকদের খাবার। আগে ছিল বাংলার চাট, এখন বিলিতির!’’
ভড়ুই মেরে খাওয়া নিষিদ্ধ হওয়ার পরে বন দফতর মানুষকে সচেতন করার কাজ শুরু করে। আইনি পদক্ষেপও নেওয়া হয়। কৃষ্ণগরের এক কেটারার ভোজবাড়িতে ভড়ুইয়ের রোস্ট বানিয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন। দূরপাল্লার বাসে ভড়ুই আনার সময়েও গ্রেফতার করা হয়েছিল এক জনকে। বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল বাসটিও।
কিন্তু ধরপাকড়েও বেশি দিন বন্ধ থাকেনি কারবার। বছরের এই সময়ে ঝুঁকি নিয়ে অনেকেই এই ব্যবসা করে চলেছেন। এক কারবারির কথায়, "৬০০ টাকায় ২০টি পাখি কিনে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি করি। ঝুঁকি আছে ঠিকই। কিন্তু চাহিদাও বিপুল। দোল বা অন্য অনুষ্ঠানের সময়ে বিক্রি আরও বেড়ে যায়। চৈত্রের শেষে যখন ভড়ুই আর মেলে না, ফোন করে আরও চড়া দাম দিতে চান খদ্দেররা।
নদিয়া-মুর্শিদাবাদের ডিএফও রানা দত্ত বলেন, ‘‘ভড়ুই ধরা, মারা, কেনা, বেচা পুরোটাই বেআইনি। আমরা সব হোটেল, বাজারে নোটিস দিয়েছি। এ বছর প্রায় ৯০০ ভড়ুই পাখি মুর্শিদাবাদ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। কারবারিরা ধরাও পড়েছে।’’
তা সত্ত্বেও ঢালাও কারবার চলছে কী করে? ডিএফও-র দাবি, ‘‘নজরদারি চলছে। ক্রেতা বা বিক্রেতা, যে-ই ধরা পড়ুক, আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
আইন থাকে আইনের জায়গায়, আর মুন্ডু যায় ঝাঁকে ঝাঁকে ভড়ুইয়ের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy