পাল-বাড়ি: বিক্রির জন্য তৈরি। কৃষ্ণনগরে। নিজস্ব চিত্র।
চড়কের মেলা থেকে সরু মুখের কুঁজো কিংবা একটা প্রমাণ সাইজের বড় মুখের মাটির কলসি কেনা একসময় প্রায় বাধ্যতামূলক ছিল।
পয়লা বৈশাখের দিন সকালে নতুন মাটির কলসি ভর্তি জলের সঙ্গে অন্ন এবং নতুন বস্ত্র ব্রাহ্মণকে দান করে বাণিজ্য শুরু করতেন ব্যবসায়ীরা। অনেক গৃহস্থ বাড়িতে মাটির ‘কলসি উৎসর্গ’ করতেন।
সেকালে ঠান্ডা জলের জন্য ভরসা ছিল নদীর বালি আর মাটি দিয়ে তৈরি জলপাত্র। পোড়ামাটির লালচে পাত্রের গায়ে চিকচিক করত বালিতে মিশে থাকা অভ্র। কেউ কেউ আবার কলসির জলে ফেলে দিতেন দু-এক দানা কর্পূর। সুগন্ধি শীতল সে জলের স্বাদই আলাদা।
কলসি-কুঁজো-জালা হরেক কিসিমের মাটির পাত্র ছিল সে কালের গরমে ঠান্ডা জলের উৎস। পুজোর মরশুম শেষ হলেই ব্যস্ততা শুরু হয়ে যেত পালবাড়িতে। বেথুয়াডহরির যুগপুর কিংবা করিমপুরের গোয়াসের পালপাড়া থেকে তামাম জেলার মাটির কলসি সরবরাহ হত।
হোগলবেড়িয়ার তিন পুরুষের মাটির জিনিসের কারিগর উত্তম পালের স্পষ্ট মনে আছে ছোটবেলায় বাড়ির উঠোন ভর্তি মাটির কলসি-কুঁজো শুকোতে দেওয়া হতো। তখন দাদু ছিলেন প্রধান কারিগর। তৈরি হওয়ার পরে মাথায় করে বিক্রি করতে বের হতেন। বাবার আমলেও একই ভাবে কলসি বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এখন উত্তমবাবুর আমলে মাটির অন্যান্য জিনিস তৈরি হলেও কলসি তৈরি হয় না বললেই চলে।
তাঁর কথায়, ‘‘যবে থেকে ঘরে ঘরে ফ্রিজ এসেছে আর মানুষ বোতলে জল খাওয়ার অভ্যাস রপ্ত করেছে, সেই দিন থেকেই মাটির কুঁজো-কলসির দিন ফুরিয়েছে।”
শহরাঞ্চলে ফ্রিজ এবং ছোটবড় হরেক কোম্পানির বোতলবন্দি জল —এই দুয়ের প্রভাবে জল খাওয়ার জন্য মাটির পাত্রের ব্যবহার কমতে কমতে প্রায় নেই বললেই চলে। নবদ্বীপ বড়বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী মলয় পাল জানান, “আমাদের এ দিকে কুঁজোর বিক্রি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। উৎসব অনুষ্ঠানে কিছু কলসি এখনও বিক্রি হয়। তবে জল খাওয়ার জন্য কেউ কেনে না। মাটির কলসি থেকে জল গড়িয়ে খাওয়ার দৃশ্য কেবল সাদাকালো বাংলা ছবিতে দেখা যায়।” করিমপুরের ব্যবসায়ী প্রবীর ঘোষের মতো কেউ কেউ অবশ্য এখনও আছেন যারা বলেন, “ফ্রিজ থাক আর যাই থাক, আমার বাড়ি এবং দোকানে কুঁজোর জল চাই-ই।”
এঁদের ভরসাতেই বেঁচে আছেন মুর্শিদাবাদের কাঠালিয়া অঞ্চলের মাটির কারিগর ক্ষুদু পাল, বাদল পালেরা। বহরমপুর লাগোয়া কাঠালিয়া গ্রামের বিশেষত্ব হল কালো কুঁজো। খুব ঠাণ্ডা জলের জন্য একদা বিখ্যাত ছিল। কিন্তু এখন হাতে গোনা কয়েক জন তৈরি করেন সে জিনিস। বাদলবাবুরা জানান, গৃহস্তের ব্যবহার অনেক দিন বন্ধ হলেও আমাদের বড় ক্রেতা ছিল বিভিন্ন অফিস-কাছারি। কিন্তু এখন সে সব অফিসে ওয়াটার কুলার বসেছে। তাই শখ করে কেনার লোকেরাই আমাদের ভরসা এখন। ৫০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে বিকোয় কালো কুঁজো।
মাটি ছাড়াও পিতলের ভারী কলসিতে খুব ঠান্ডা হত জল। মুখ দেখা যায় এমন ঝকঝকে কাঁসার গ্লাসে করে জল খাওয়ার রেওয়াজ ছিল সমস্ত বনেদি বাড়িতেই। মুর্শিদাবাদের খাগড়ার কাঁসাপিতলের বাসন ছাড়া এক সময় সম্পন্ন ঘরে মেয়ে পাত্রস্থই করা যেত না। সময়ের পরিবর্তনে সেই বিয়ের দানে কিংবা উপহারই এখন কাঁসাপিতলের বাসনের একমাত্র আশ্রয়। সাধারণ গৃহস্থের বাড়ি থেকে কবেই উঠে গিয়েছে কাঁসার বাসনের ব্যবহার। মেলামাইন বা বোন চায়নার পাতলা রঙিন বাসনে সাজানো এখন গৃহস্থের খাওয়ার টেবিল।
দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
নবদ্বীপ
পাল-বাড়ি: বিক্রির জন্য তৈরি। কৃষ্ণনগরে। নিজস্ব চিত্র।
চড়কের মেলা থেকে সরু মুখের কুঁজো কিংবা একটা প্রমাণ সাইজের বড় মুখের মাটির কলসি কেনা একসময় প্রায় বাধ্যতামূলক ছিল।
পয়লা বৈশাখের দিন সকালে নতুন মাটির কলসি ভর্তি জলের সঙ্গে অন্ন এবং নতুন বস্ত্র ব্রাহ্মণকে দান করে বাণিজ্য শুরু করতেন ব্যবসায়ীরা। অনেক গৃহস্থ বাড়িতে মাটির ‘কলসি উৎসর্গ’ করতেন।
সেকালে ঠান্ডা জলের জন্য ভরসা ছিল নদীর বালি আর মাটি দিয়ে তৈরি জলপাত্র। পোড়ামাটির লালচে পাত্রের গায়ে চিকচিক করত বালিতে মিশে থাকা অভ্র। কেউ কেউ আবার কলসির জলে ফেলে দিতেন দু-এক দানা কর্পূর। সুগন্ধি শীতল সে জলের স্বাদই আলাদা।
কলসি-কুঁজো-জালা হরেক কিসিমের মাটির পাত্র ছিল সে কালের গরমে ঠান্ডা জলের উৎস। পুজোর মরশুম শেষ হলেই ব্যস্ততা শুরু হয়ে যেত পালবাড়িতে। বেথুয়াডহরির যুগপুর কিংবা করিমপুরের গোয়াসের পালপাড়া থেকে তামাম জেলার মাটির কলসি সরবরাহ হত।
হোগলবেড়িয়ার তিন পুরুষের মাটির জিনিসের কারিগর উত্তম পালের স্পষ্ট মনে আছে ছোটবেলায় বাড়ির উঠোন ভর্তি মাটির কলসি-কুঁজো শুকোতে দেওয়া হতো। তখন দাদু ছিলেন প্রধান কারিগর। তৈরি হওয়ার পরে মাথায় করে বিক্রি করতে বের হতেন। বাবার আমলেও একই ভাবে কলসি বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এখন উত্তমবাবুর আমলে মাটির অন্যান্য জিনিস তৈরি হলেও কলসি তৈরি হয় না বললেই চলে।
তাঁর কথায়, ‘‘যবে থেকে ঘরে ঘরে ফ্রিজ এসেছে আর মানুষ বোতলে জল খাওয়ার অভ্যাস রপ্ত করেছে, সেই দিন থেকেই মাটির কুঁজো-কলসির দিন ফুরিয়েছে।”
শহরাঞ্চলে ফ্রিজ এবং ছোটবড় হরেক কোম্পানির বোতলবন্দি জল —এই দুয়ের প্রভাবে জল খাওয়ার জন্য মাটির পাত্রের ব্যবহার কমতে কমতে প্রায় নেই বললেই চলে। নবদ্বীপ বড়বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী মলয় পাল জানান, “আমাদের এ দিকে কুঁজোর বিক্রি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। উৎসব অনুষ্ঠানে কিছু কলসি এখনও বিক্রি হয়। তবে জল খাওয়ার জন্য কেউ কেনে না। মাটির কলসি থেকে জল গড়িয়ে খাওয়ার দৃশ্য কেবল সাদাকালো বাংলা ছবিতে দেখা যায়।” করিমপুরের ব্যবসায়ী প্রবীর ঘোষের মতো কেউ কেউ অবশ্য এখনও আছেন যারা বলেন, “ফ্রিজ থাক আর যাই থাক, আমার বাড়ি এবং দোকানে কুঁজোর জল চাই-ই।”
এঁদের ভরসাতেই বেঁচে আছেন মুর্শিদাবাদের কাঠালিয়া অঞ্চলের মাটির কারিগর ক্ষুদু পাল, বাদল পালেরা। বহরমপুর লাগোয়া কাঠালিয়া গ্রামের বিশেষত্ব হল কালো কুঁজো। খুব ঠাণ্ডা জলের জন্য একদা বিখ্যাত ছিল। কিন্তু এখন হাতে গোনা কয়েক জন তৈরি করেন সে জিনিস। বাদলবাবুরা জানান, গৃহস্তের ব্যবহার অনেক দিন বন্ধ হলেও আমাদের বড় ক্রেতা ছিল বিভিন্ন অফিস-কাছারি। কিন্তু এখন সে সব অফিসে ওয়াটার কুলার বসেছে। তাই শখ করে কেনার লোকেরাই আমাদের ভরসা এখন। ৫০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে বিকোয় কালো কুঁজো।
মাটি ছাড়াও পিতলের ভারী কলসিতে খুব ঠান্ডা হত জল। মুখ দেখা যায় এমন ঝকঝকে কাঁসার গ্লাসে করে জল খাওয়ার রেওয়াজ ছিল সমস্ত বনেদি বাড়িতেই। মুর্শিদাবাদের খাগড়ার কাঁসাপিতলের বাসন ছাড়া এক সময় সম্পন্ন ঘরে মেয়ে পাত্রস্থই করা যেত না। সময়ের পরিবর্তনে সেই বিয়ের দানে কিংবা উপহারই এখন কাঁসাপিতলের বাসনের একমাত্র আশ্রয়। সাধারণ গৃহস্থের বাড়ি থেকে কবেই উঠে গিয়েছে কাঁসার বাসনের ব্যবহার। মেলামাইন বা বোন চায়নার পাতলা রঙিন বাসনে সাজানো এখন গৃহস্থের খাওয়ার টেবিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy