Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

গণিতে সম্মানিত রূপান্তরকামী

মঞ্চে সুমনা। নিজস্ব চিত্র

মঞ্চে সুমনা। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কল্যাণী শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৮ ০১:৩৩
Share: Save:

ছোট থেকেই পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন। অন্যদের থেকে আলাদা হওয়ার দরুন পড়শিরাও দেখতেন বাঁকা নজরে। ঠিকানা হয়েছিল করিমপুরের একটি অনাথ আশ্রম। সেখানেও যে সুখের সময় কেটেছে, তা নয়।

সুমন প্রামাণিক, যিনি নিজেকে ‘সুমনা’ বলতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। পুরুষ দেহে বন্দি নারীর মন তাঁর। রুপান্তরকামী হওয়ায় মূলস্রোতের মানুষেরা তাঁকে ছোট থেকেই ‘অপর’ করে রেখেছিলেন। বৃহস্পতিবার কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৯তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সম্মানিত হলেন সুমনা। এ বছর গণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পেলেন সুমনা। রাজ্যপাল তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য কেশরীনাথ ত্রিপাঠী তাঁর হাতে তুলে দিলেন মানপত্র। আর সুমনা বললেন, ‘‘এটা আমার কাছে বিরল সম্মান। ছোট থেকে যে সমাজ আমাকে কেবলই অসম্মান করে এসেছে, আজ সেই সমাজই আমাকে স্বীকৃতি দিল।’’

সুমনার মনে পড়ে, যখন তিনি করিমপুরে জগন্নাথ হাইস্কুলে পড়েন, তখন থেকেই তিনি লাঞ্ছনার শিকার। সহপাঠীরা কেউই তাঁর সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করত না। কেউ বই-খাতা ছিঁড়ে দিত, কেউ লুকিয়ে রাখত কষ্ট করে তৈরি করা নোটের খাতা। তবে এক শিক্ষকের কথা আলাদা করে মনে পড়ে তাঁর। তিনি সুব্রত সরকার। সুমনার কথায়, ‘‘সুব্রতবাবু ছিলেন সবার থেকে আলাদা। উনি কেবল আমায় মানুষ ভাবতেন। স্যারের কাছে লিঙ্গ পরিচয় কোনও দিনই বিবেচ্য ছিল না।’’

মূলত সুব্রত স্যারের সাহায্যেই সুমনা মাধ্যমিকে ভাল ফল করেন। তার পরে বিজ্ঞান নিয়ে ভর্তি হন কৃষ্ণনগরের কবি বিজয়লাল হায়ার সেকেন্ডারি ইনস্টিটিউটে। তার পরে বগুলা কলেজ। ‘‘ভেবেছিলাম, এ বার উচ্চশিক্ষার জগতে প্রবেশ করলাম, এখানে হয়তো বিভাজন হবে না। কিন্তু বঞ্চনার অভিজ্ঞতাই ফিরে এল। বিভাগের শিক্ষকদেরও কাছ থেকেও যথাযথ সম্মান জোটেনি’’ — আজও আক্ষেপ যায় না সুমনার।

স্নাতক হওয়ার পরে কৃষ্ণনগর মহিলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ তথা দেশের প্রথম রূপান্তিত কলেজ অধ্যক্ষ মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহায্যে তিনি ভর্তি হন কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সুমনার দাবি, তিনিই প্রথম রূপান্তরকামী যিনি ফলিত গণিত বিভাগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখানে এসেও তিনি কিন্তু সে-ই একাই। সকলেই যেন কেমন ‘অস্বাভাবিক’ আচরণ করছেন, মনে হত তাঁর। এক সময়ে তো পড়াশোনা ছাড়ার কথাও ভেবেছিলেন।

সেই সময়ে পাশে দাঁড়ান সিনিয়র দাদা তুহিন ঘোষ। মূলত তুহিনের অনুপ্রেরণাতেই এমএসসি এমএসসি করা হল তাঁর। তবে সংগ্রামের শেষ এখানেও নয়। এখনও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়নি। কৃষ্ণনগরের একটি বাড়িতে থেকে টিউশন করে কোনও ভাবে নিজের খরচ চালান। কবে তিনি যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবেন, প্রতিষ্ঠা পাবেন মূলস্রোতে, সেই অপেক্ষাতেই চলছে দিন গোনা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE