Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Domkal

প্রতিবাদ ভাষা পাওয়ায় কমেছে সালিশি সভা

অধিকাংশ সময়েই বিচার হত একপেশে। ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে সালিশির রায় যেত বিত্তবান বা এলাকায় প্রভাবশালীদের পক্ষেই।

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

সুজাউদ্দিন বিশ্বাস
ডোমকল শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৩:৪৪
Share: Save:

এলাকার এক হাজী পরিবারের মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছিল দিনমজুর পরিবারের এক যুবকের। আর সেই ‘অপরাধে’ই এক সময়ে গ্রাম ছাড়তে হয়েছিল জলঙ্গির গিয়াসুদ্দিন মণ্ডলকে (নাম পরিবর্তিত)। তবে ডোমকলে পরিচারিকার কাজ করা এক মহিলার ১৫ বছরের মেয়ে তবাসুমকে মরতে হয়েছিল গ্রামের বর্ধিষ্ণু পরিবারের এক যুবকের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার জন্য।

কারণ, সালিশি সভা থেকে যাবতীয় অভিযোগের তির উড়ে এসেছিল তাঁদের দিকেই। ঘুরেফিরে মোড়লদের পক্ষ থেকে একটাই কথা ভেসে এসেছিল, ‘বামন হয়ে চাঁদে হাত দেওয়া। দ্যাখ, কেমন শাস্তি পেতে হয়!’ গিয়াসুদ্দিনকে মোড়লরা ‘নিদান’ দিয়েছিল, হয় তাকে গ্রাম ছাড়তে হবে, না হলে মাথা ন্যাড়া করে জুতোর মালা পরিয়ে গোটা গ্রাম তাকে ঘোরানো হবে। শেষ পর্যন্ত নিজের ও পরিবারের সম্মান বাঁচাতে গ্রামই ছেড়েছিল গিয়াসুদ্দিন। কিন্তু অসহায় ছিল তবাসুম। তার কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না। মোড়লদের একের পর এক অশালীন প্রশ্নবাণে অপমানিত হয়ে একদিন বাড়ির পাশের কাঁঠাল গাছ থেকে ঝুলে পড়ে সে। গ্রামীণ এলাকায় সালিশি মানে ছিল কঠোর শাসন। তবে অধিকাংশ সময়েই বিচার হত একপেশে। ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে সালিশির রায় যেত বিত্তবান বা এলাকায় প্রভাবশালীদের পক্ষেই।

সালিশি বসার কায়দাটাও প্রায় একই রকম সব জায়গায়। গ্রামের যে কোনও ছুতোনাতা বিষয়ে সালিশি বসত। চাঁদের আলোয়, কখনও আবার হ্যাজাক জ্বালিয়ে গাছতলায় বসে পড়ত মাতব্বরেরা। অধিকাংশ সময়ে গ্রামের অসহায় দরিদ্র মানুষের ওপরেই তাঁদের বিচারের খাঁড়া নেমে আসত। ডোমকলের বাসিন্দা, একটি মানবাধিকার সংগঠনের কর্মী মতিউর রহমান বলছেন, ‘‘একটা সময় আমার গ্রাম ফতেপুরে হাজী বাড়ির এক যুবকের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠেছিল। গ্রামের এক তন্তুবায় পরিবারের এক তরুণী ওই অভিযোগ এনেছিল।

অভিযুক্তের ঠাকুর্দা ছিলেন গ্রামের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি। গোটা গ্রামের মানুষ তাঁর ওপরেই ভার দিয়েছিলেন নাতির বিচারের। ভরা সালিশি সভায় নাতিকে দুটো থাপ্পড় কষিয়ে তিনি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বাড়িতে। তারপর অন্যদের বলেছিলেন, এর চেয়ে আর কঠিন আর কি শাস্তি দেব!’’ গ্রামেগঞ্জে সালিশির এহেন অন্যায়-অবিচার দেখে এক সময় গর্জে উঠতে শুরু করেন একদল গ্রামবাসী। তাঁরা প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। সরব প্রতিবাদ না হলেও ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে শুরু করে। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের কাছেও অভিযোগ দায়ের হয় সালিসি সভা বসার পরেও। উচ্চ আদালতের নির্দেশে পুলিশও অনেক ক্ষেত্রে সালিশির বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করেছে। আর তাতেই ধীর ধীরে কমেছে সালিশির অত্যাচার। যদিও তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি এখনও।

সালিশির ধরন বদলেছে এখন। মাতব্বরদের বদলে এখন রাজনৈতিক নেতারা সালিশির ‘বিচারকের’ ভূমিকায় অবতীর্ণ। তবে কোনও জটিল বিষয় নয়। জমিজমা নিয়ে সমস্যা, পারিবারিক বিবাদ মেটাতেই বসে সালিশি। ডোমকলের রায়পুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান জান মহম্মদ মণ্ডল বললেন, ‘‘পারিবারিক বিবাদ বা জমি সংক্রান্ত সমস্যায় অনেকেই আদালতে যেতে পারেন না টাকার অভাবে। তাঁদের ক্ষেত্রে গ্রামীণ সালিশির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তবে সালিশি সভাকে নিরপেক্ষ হতে হয়। নইলে সেই রায় মেনে না নেওয়ারই সম্ভাবনা।’’

আইনজীবী শাহনুর আলম বলেন, ‘‘গ্রামীণ এলাকার মানুষ অনেক সময়েই মামলা-মোকদ্দমার খরচের কথা ভেবে পিছিয়ে আসেন। তাঁরা তখন সালিশি সভার বিচারের ওপরেই ভরসা করেন। একটা সময় গ্রামে সালিশির বাড়বাড়ন্ত ছিল। বর্তমানে যাতায়াত ব্যবস্থা অনেক ভাল হয়েছে। বিভিন্ন মহকুমা এলাকায় তৈরি হয়েছে আদালত। ফলে আইনের দ্বারস্থ হওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে মানুষের।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Domkal Arbitration Meeting
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE