শনিবার, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা।
শোনা গিয়েছিল, বিরহী ও কল্যাণী মোড়ের বেশির ভাগ চায়ের দোকান ও হোটেলে গেলেই ওভারলোডিংয়ের ছাড়পত্রের জন্য কার্ড মিলবে। লাইনে যার চেনা নাম ‘মান্থলি’।
বিরহী মোড়ে বছর পনেরো ধরে চলা চায়ের দোকানের মালিককে বলা হল, ‘‘ভাই, জাতীয় সড়কে আমাদের বালি-পাথরের গাড়ি চলে। পুলিশের খুব উৎপাত। কী ভাবে মান্থলি করা যায়?’’ যে ছেলেটি দোকান চালাচ্ছিল, সে বলল, ‘‘একটু অপেক্ষা করুন। এখানে অনেকেই এই কাজ করে। আমি ফোন করছি। এখনই কেউ না কেউ চলে আসবে।’’
মিনিট সাতেকের মধ্যে আরিফুল হক নামে একটি যুবক মোটরবাইকে চেপে চলে এল চায়ের দোকানের সামনে। সে বলল, ‘‘দাদা, আজ তো হবে না। আগামিকাল সকালে ফোন করুন।’’ নিজের ফোন নম্বরও দিল সে। জানতে চাওয়া হল, আপনি কোথা থেকে আসছেন ভাই? যুবকটি বলল, ‘‘রানাঘাট থেকে।’’
কথায় কথায় আরিফুল বলল, ‘‘আপনাকে আমার খুব চেনা লাগছে।’’ তা অবশ্য লাগতেই পারে। এর আগে ওভারলোডিং গাড়ির ক্ষেত্রে পরিবহণ দফতরের কার্ড বা গাড়ি নম্বর নথিভুক্ত করার খবর করতে ওই এলাকায় যাওয়া হয়েছিল। সেই সময়ে চাক্ষুস হয় জহিরুল মণ্ডল ওরফে ‘মাস্টারদা’র কাজ কারবার। আদতে প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক জহিরুলের সঙ্গে কথা বলার সময় সে দিন তার বহু শাগরেদ এসে জুটেছিল। আরিফুল হয়তো তাদেরই এক জন। এলাকার লোকজনই বলছেন, ‘‘ওদের সকলের গুরুই তো মাস্টারদা!’’
চাকদহের এক লরির মালিকের অভিযোগ, বীরভূম থেকে আসে পাথর। বর্ধমান ও বাঁকুড়া থেকে বালি। মোহনপুর ছাড়াও নদিয়ার আরও কয়েকটি থানা ওভারলোডিংয়ের জন্য ‘মান্থলি কার্ড’ করায়। তাই সন্ধ্যার পরে জাতীয় সড়কে ওভারলোডেড গাড়ি সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পুলিশ দেখে নেয়, সব গাড়ির নম্বর তাদের খাতায় নথিভুক্ত হয়েছে কি না। এতেই যানজট হয়। অতিরিক্ত মালবাহী গাড়িগুলি রাস্তার দফারফা করে। সন্ধ্যায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে যে কোনও গাড়ির চালককে জিজ্ঞাসা করলেই বলে দেবেন, এই গাড়ির নম্বর কে ‘এন্ট্রি’ করেছে। এই ভাবেই বিরহী ও কল্যাণী মোড়ে চলছে সিন্ডিকেট।
বিরহীর ওই মোড়ে কার্ড না পেয়ে যাওয়া গেল কল্যাণী মোড়ের একটি পেট্রল পাম্পের গা ঘেঁষা চায়ের দোকানে। খবর ছিল, পুলিশের লোক দিয়ে ওখানে কার্ড করায়। সেখানে গিয়ে লাল চায়ে চুমুক দিতে-দিতে বলা গেল, কার্ড চাই।
দোকানেই বসে ছিল দুই যুবক। তারা বলল, ‘‘এই মুহূর্তে তো কার্ড নেই। তবে পাল হোটেলে চলে যান। সেখানে রয়েছে পুলিশের ‘ডাক মাস্টার’ ভোলা। মোহনপুর তদন্তকেন্দ্রের গাড়ি চালক হাফিজুল মণ্ডলও থাকতে পারে। ওদের কেউ এক জন কার্ড দেবে।’’
কিন্তু সেখানে গিয়েও মিলল না কার্ড। পরে এক জন কয়েকটি কার্ড দেখালেন। তাঁর দাবি, ‘‘মোহনপুর তদন্তকেন্দ্র ছাড়াও পড়শি উত্তর ২৪ পরগনারও বিভিন্ন থানার কার্ড পাওয়া যায়। কিন্তু আপনাকে একটু যাচাই না করে তো কার্ড দেওয়া যাবে না! তাই এখনই কেউ দিচ্ছে না।’’
পরে হাফিজুলকে ফোন করে বলা হল, ‘‘স্যর, চাকদহের শিলিন্দা থেকে বলছি। বালি-পাথরের নতুন কারবার শুরু করেছি। তাই কার্ড লাগবে।’’ হাফিজুল বললেন, ‘‘আরে, বলবেন না! মোহনপুরের পুলিশ আমাকে সে ভাবে টাকা দেয় না। তাই আপাতত ওদের কাজটা বন্ধ রেখেছি। তবে আপনি পাল হোটেলে চলে যাবেন, ওখানেই তদন্তকেন্দ্রের কার্ড হবে। আমি এখন আমডাঙা-সহ উত্তর ২৪ পরগনার কয়েকটি থানার কার্ড করি। ওখানে ভাল লাভ পাই।’’
মোহনপুর তদন্তকেন্দ্রের ইনচার্জ প্রসেনজিৎ কর অবশ্য গোটা বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তাঁর দাবি, ‘‘আমি এ সব কিছুই জানি না। এ সব হতেই পারে না!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy