রাজকুমার পাল। নিজস্ব চিত্র
বারান্দায় এক পাশে চৌকিতে রয়েছে গুটিকয়েক ব্যাগ। তার অধিকাংশের মধ্যে রয়েছে কাগজ। একটা ব্যাগ থেকে কয়েকটি কাগজ বের করেন। যার কোনওটা অস্পষ্ট, কোনওটা আবার কোঁচকানো। কোনওটা ভাঁজ করা।
কয়েকটি কাগজ খাটের উপর ছড়িয়ে দিয়ে মাস্টারমশাই বলেন, “এখন আমার লড়াই হাঁসখালির মামজোয়ানে চূর্ণী নদীর উপর সেতু তৈরি করা। এর আগে অনেক লড়াই করে ১৯৯৫ সালে ধানতলার আড়ংঘাটা আর ২০১৬ সালে কৃষ্ণগঞ্জের শিবনিবাসে একই নদীর উপর সেতু তৈরি করিয়েছি। এখন লক্ষ্য মামজোয়ান। এর জন্য যতদূর যেতে হয় যাব।”
ধানতলা থানার আনন্দনগরে বাড়ি রাজকুমার পালের, যিনি এলাকায় পরিচিত মাস্টারমশাই নামেই। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হওয়ার কারণেই এলাকার সকলে তাঁকে ওই নামে ডাকেন। রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পাওয়া ওই শিক্ষক এলাকার মানুষের জন্য কাজ করেছেন আজীবন।
এ দিন রাজকুমার নিজের বাড়িতে বসে বলেন, “আমার স্কুলের পঠনপাঠন-সহ বিভিন্ন বিষয়ে ভাল কাজ হওয়ার জন্য প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালাম আমায় পুরস্কার দিয়েছিলেন।”
চূর্ণী নদীর এক দিকে আনন্দনগর। অন্য দিকে আড়ংঘাটা। এক সময়ে নৌকায় নদী পার হতেন এলাকার মানুষ। যে কারণে বার বার তাঁদেরকে সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে। তখনই চূর্ণী নদীর উপরে একটি সেতু তৈরির দাবি উঠেছিল। এলাকার মানুষের সেই দাবি নিয়ে লড়াই শুরু করেন সকলের প্রিয় মাস্টারমশাই। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দরবার করেছিলেন বছর বিরাশির রাজকুমার। শেষমেষ ১৯৯৫ সালে এই নদীর উপরে সেতু তৈরি করে রাজ্য পূর্ত দফতর।
তবে, এখানেই থেমে যাননি ওই বৃদ্ধ। সেতু তৈরি হওয়ার পর থেকে নিয়মিত সেই সেতু নিজে হাতে পরিষ্কার করেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘এই সেতুকে আমার আরেক সন্তান বলে মনে করি। তাই তা পরিষ্কার রাখার সব রকমের চেষ্টা করি। সময় পেলেই ছুটে যাই ওখানে।”
রানাঘাট ২ নম্বর ব্লকের খিসমা গ্রাম পঞ্চায়েতের আনন্দনগরে বাড়ি এই প্রাক্তন শিক্ষকের। তিনি ঘোড়াঘাটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ২০০২ সালে অবসর নেন। তাঁর তিন মেয়ে এবং দুই ছেলে। পথ-দুর্ঘটনায় এক ছেলের মৃত্যু হয়েছে। বাকিরা বিয়ে করে থিতু হয়েছেন। রাজকুমারের স্ত্রী সবিতা পাল বলেন, “তিনি যে কাজটা করছেন, সেটা ভাল কাজ। কিন্তু, আমরা ওঁকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় থাকি। বয়স হয়েছে। যে ভাবে সেতুর উপর দিয়ে গাড়ি যাতায়াত করে, যে কোনও সময়ে কেউ ওঁকে ধাক্কা মেরে চলে যেতে পারে!”
একই কথা তাঁর ছেলে বাপি পালেরও— “সময় পেলেই বাবা সেতু পরিষ্কার করতে শুরু করে দেয়। এমনকি, অনেক সময় কোনও কাজে বাইরে গিয়েছেন, সেখান থেকে বাড়ি না ফিরে সেতু পরিষ্কার করতে শুরু করে। তখন আর বাড়ি ফেরার ঠিক থাকে না বাবার।”
এলাকায় সেতু তৈরি হওয়ায় খুশি এলাকার মানুষ। আনন্দনগরের বাসিন্দা রাজু সাহা এবং আড়ংঘাটা শবদলপুরের বাসিন্দা রাজর্ষি ঘোষ জানান, রাজকুমারের চেষ্টাতেই এই সেতু নির্মাণ সম্ভব হয়েছে। রাজর্ষি বলেন, ‘‘সেতু তৈরি হওয়ায় দুই পারের মানুষের কী যে উপকার হয়েছে, তা ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়। সেতুর কারণে এলাকার গুরুত্বও বেড়ে গিয়েছে।”
কৃষ্ণগঞ্জের বিধায়ক সত্যজিত বিশ্বাস বলেন, “কে কী করেছিলেন তা বলতে পারব না। শিবনিবাসের সেতুটির কাজ মাঝপথে বন্ধ হয়েছিল। আমি বিধায়ক হওয়ার পর তদ্বির করে কাজ শেষ করা সম্ভব হয়েছে।”
রানাঘাট মহকুমা পুর্ত দফতরের বাস্তুকার অনুপ দালাল বলেন, “সেতু পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব আমাদের। সেটা মাঝে-মাঝে করা হয়। মামজোয়ানের সেতু তৈরির বিষয়টি এখনও বেশিদূর এগোয়নি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy