Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ইতিহাস বুকে পর্যটনের দোর খোলার অপেক্ষায় মতিঝিল

প্রায় আড়াইশো বছরের পুরনো ইতিহাস উসকে দেওয়ার অপেক্ষায় মতিঝিল পর্যটন কেন্দ্র। ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে খোলা আকাশের নীচে আসার প্রতীক্ষায় সিরাজউদ্দৌলা, মুর্শিদকুলি খাঁ, আলিবর্দি খাঁ, ঘসেটি বেগম, লর্ড ক্লাইভ, মির জাফর, ওয়াটসন, জগৎ শেঠ, ওয়ারেন হেস্টিংস।

ইতিহাস যেন নেমে এসেছে মতিঝিল পার্কে। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।

ইতিহাস যেন নেমে এসেছে মতিঝিল পার্কে। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।

শুভাশিস সৈয়দ
লালবাগ শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:৩৩
Share: Save:

প্রায় আড়াইশো বছরের পুরনো ইতিহাস উসকে দেওয়ার অপেক্ষায় মতিঝিল পর্যটন কেন্দ্র। ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে খোলা আকাশের নীচে আসার প্রতীক্ষায় সিরাজউদ্দৌলা, মুর্শিদকুলি খাঁ, আলিবর্দি খাঁ, ঘসেটি বেগম, লর্ড ক্লাইভ, মির জাফর, ওয়াটসন, জগৎ শেঠ, ওয়ারেন হেস্টিংস।

সৌজন্যে, রাজ্য পর্যটন দফতর এবং মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসন।

১৭৫০-৫১ খ্রিস্টাব্দে আলিবর্দি খাঁয়ের জ্যেষ্ঠ জামাতা তথা ঘসেটি বেগমের (মেহেরুন্নেসা) স্বামী নবাব নওয়াজেস মহম্মদ খাঁ সুদৃশ্য মতিঝিল এবং সেই ঝিলের পাড়ে ‘সাংহী দালান’ (শাহী দালান) নামে এক প্রাসাদ নির্মাণ করেন। বর্তমানে অবশ্য দালানটি বিলুপ্ত। সাক্ষী হিসেবে রয়ে গিয়েছে শুধু দালানের ভিত এবং ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা ভাঙা অংশ। রাজ্য পর্যটন দফতর গোটা এলাকার ৪৬ একর জমি নিয়ে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুললেও পরিকল্পনা থেকে কার্যকরী রূপ দেওয়া এবং যাবতীয় কাজ দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে জেলা প্রশাসন। জেলাশাসক ওয়াই রত্নাকর রাও বলেন, “ওই পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারি দফতর যৌথ ভাবে কাজ করছে। তার মধ্যে রয়েছে উদ্যানপালন দফতর, সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতর, জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতর এবং পূর্ত দফতর। রয়েছে নাবার্ডও।”

২০১৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর মতিঝিল পর্যটন কেন্দ্রের শিলান্যাস করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যেপাধ্যায়। ২০১৪ সালের ৮ অগস্ট প্রশাসনিক বৈঠকে নদিয়ায় গিয়ে সেখান থেকেই তিনি এটি উদ্বোধন করেন। কিন্তু তখনও বেশ কিছু কাজ অসম্পূর্ণ ছিল। ফলে তার পরে বেশ কয়েক মাস কেটে গেলেও ওই পর্যটন কেন্দ্রে এখনও সাধারণের পা পড়েনি। ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসনের তরফে নদিয়ার ঘূর্ণি এলাকার শিল্পী, সহোদর সুদীপ্ত পাল ও জয়ন্ত পালকে বরাত দেওয়া হয় সিরাজউদ্দৌলা, মুর্শিদকুলি খাঁ, আলিবর্দি খাঁয়েদের মূর্তি বানানোর। সুদীপ্ত বলেন, “প্রথমে মাটির মূর্তি গড়ে তার উপরে প্যারিসের ছাঁচ তৈরি করা হয়েছে। পরে ফাইবার গ্লাসের ঢালাই দেওয়া হয়েছে। মূর্তিগুলি গড়ার সময়ে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও যাতে ফুটে ওঠে সে দিকটা মাথায় ছিল আমাদের। তাই মূর্তি গড়ার আগে বিভিন্ন ঐতিহাসিক সিনেমা দেখে সেই সময়ের পোশাক সম্পর্কে ধারণা তৈরি করেছি আমরা। চরিত্রগুলির কথা বলার ভঙ্গিমাও খেয়াল রাখতে হয়েছে।”

মূর্তিগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড় সিরাজউদ্দৌলার মূর্তি, প্রায় সাড়ে ৭ ফুট উচ্চতার। পর্যটন কেন্দ্রের ভিতরে সাংহী দালানের ঠিক সামনে চেয়ারে বসে আলোচনায় ব্যস্ত ঘসেটি বেগম, লর্ড ক্লাইভ, মির জাফর, জগৎ শেঠ এবং ওয়াটসন। আলোচনার মধ্যমণি ঘসেটি। স্থানীয় ইতিহাসবিদ খাজিম আহমেদ বলেন, “সিরাজউদ্দৌলাকে মসনদ থেকে হটানোর জন্য তৎকালীন নবাব-বিরোধী শক্তি অসংখ্য বার বৈঠকে মিলিত হন। ঘসেটি তাঁদের অন্যতম। ফলে ওই সাংহী দালানে পলাশি যুদ্ধের ষড়ষন্ত্রের চিত্রনাট্য তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে প্রাসাদ লাগোয়া মতিঝিলের বাগানে সাত দিন ধরে জাঁকজমকের সঙ্গে হোলি উৎসব পালনের ইতিহাসও রয়েছে।”

জেলাশাসক জানান, সাংহী দালানের প্রবেশপথের তোরণ জরাজীর্ণ ছিল। ইতিহাসবিদদের পরামর্শ নিয়ে সেই কালের স্থাপত্যের আঙ্গিকে নতুন তোরণ গড়া হয়েছে। মুঘল গার্ডেন, ল্যান্ডস্কেপ গার্ডেন তৈরির সময়েও ইতিহাসকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। প্রায় সাত হেক্টর জমি নিয়ে তৈরি করা রয়েছে ফলের বাগান। সেখানে ৪৩টি প্রজাতির আমের গাছ ও বিভিন্ন ফলের গাছ রয়েছে। প্রজাপতি আকর্ষণ করবে এমন ফুল ও ফলের গাছ রয়েছে প্রজাপতি আকারের বাটারফ্লাই গার্ডেনে। প্রায় ২৫৫ একর জমির নিয়ে গড়ে ওঠা অশ্বক্ষুরাকৃতি ঝিল রেলিং দিয়ে ঘেরার কাজ চলছে। ওয়াচ টাওয়ার তৈরি হচ্ছে। লোকগান ও লোকনৃত্য পরিবেশনের জন্য খোলা আকাশের নিতে মুক্তমঞ্চ তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে ন’টি বিলাসবহুল কটেজ। ফুড কোর্টের পাশাপাশি থাকছে ক্যাফেটেরিয়াও। জেলাশাসকের দাবি, “মিউজিক্যাল ফাউন্টেন নামে প্রায় ৮০ ফুট উঁচু নৃত্যরত ঝরনা তৈরি হয়েছে, যা রাজ্যে আর কোথাও নেই।” সব ঠিকঠাক চললে আর সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে খুলে যেতে পারে মতিঝিল পর্যটন কেন্দ্র। লালবাগ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, “এই পর্যটন কেন্দ্র ঘিরে যে কর্মকাণ্ড হয়েছে, তাতে ভবিষ্যতে হাজারদুয়ারির সঙ্গেও মতিঝিলের নাম এক সঙ্গে উচ্চারিত হতে পারে।” পর্যটকদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য ভাগীরথীর পাড় বরাবর বহরমপুর কাজি নজরুল ইসলাম সরণী থেকে ওই পর্যটন কেন্দ্রের প্রবেশপথ পর্যন্ত ঝকঝকে রাস্তা তৈরি করেছে জেলা পরিষদ। ওই পথে বহরমপুরের দিকে বিশাল তোরণও করা হয়েছে। স্থানীয় ইতিহাসবিদ সায়ন্তন মজুমদার বলেন, “প্রকৃতি ও ইতিহাস মিলেমিশে যাওয়াটাই মতিঝিলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। যার এক দিকে মতিঝিল মসজিদ এবং অন্য দিকে রাধামাধব মন্দির। আজান আর আরতির ধ্বনি একে অন্যের সঙ্গে মিলে যাবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

tourism motijhil subhasish sayed lalbag
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE