অকালমৃত কৌশিক রায়চৌধুরী। —ফাইল চিত্র
তাঁর স্বেচ্ছামৃত্যুর অসহ বেদনায় আজও মুহ্যমান বহরমপুর শহরের বিদ্বসমাজ। কেবল বহরমপুর কেন, কলকাতারও।
সম্প্রতি বহরমপুরের বাড়িতে মৃত্যু হয়েছে বহুমুখী প্রতিভাধর, মেধাবী ছাত্র ও নাট্য কর্মী কৌশিক রায়চৌধুরী (৫০)-র। তাঁর স্মৃতিতে দু’টি স্মরণ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় বহরমপুরে। ৭ মার্চ বহরমপুর রবীন্দ্রসদনে স্মরণসভার আয়োজন করে যুগাগ্নি। এ নাট্যসংস্থার সূত্রেই নাটকে কৌশিকের হাতেখড়ি। ১ মার্চ তাঁর স্মরণসভার আয়োজন করে ঋত্বিক। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি জড়িয়ে ছিলেন এই দলটির সঙ্গে। ঋত্বিক তাঁর স্মরণে একটি পুস্তিকাও প্রকাশ করেছে। তাতে অকপটে লেখা হয়েছে, কৌশিক কারও একার নয়, কৌশিক সবার। সকলকেই নিজের মতো করে গ্রহণ করতে পারত সে। কবি থেকে কাঙাল, প্রেমিক থেকে পাগল, খ্যাতিমান থেকে অভাজন তার আগ্রহ-পরিসরে বিচরণ করেছে।”
১৪ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টা নাগাদ বহরমপুর শহরের ইন্দ্রপ্রস্থ এলাকায় কৌশিকের ফ্ল্যাটে গিয়ে বাগরুদ্ধ হয়ে পড়েন তাঁর বাল্যবন্ধু নাট্যকর্মী শুভ সেন। দেখেন, সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলছে কৌশিকের নিথর দেহ। পায়ের নীচে রং তুলিতে কৌশিকের হস্তাক্ষরে লেখা —নিজের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও অকর্মণ্যতায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে মৃত্যু বেছে নিলাম। এই সিদ্ধান্ত আমারই। আর কেউ কোনও ভাবে দায়ী নন।...যাঁরা আমাকে ভালবাসতেন ও বাসেন, তাঁরা মার্জনা করবেন।”
দু’টি স্মরণসভাতেই শুভ বলেন, “কৌশিক দায়িত্বজ্ঞানহীন বা অকর্মণ্য কোনওটাই ছিল না। তা থাকলে সে কখনও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় বাংলা অনার্স এবং এমএ দুটোতেই প্রথম বিভাগে প্রথম হতে পারত না।” সে কথা স্বীকার করেন বহু জনে। বহরমপুরের ঋত্বিকের মতোই কলকাতার নান্দীকারের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন কৌশিক।
স্মরণসভায় বাচিক শিল্প থেকে নাট্য শিল্পে ও ‘সিনেমা ভাবনা’য় স্কুলছাত্র কৌশিকের ক্রম বিবর্তনের পথরেখাটি স্মরণ করেন যুগাগ্নি ও অমৃতকুম্ভের অন্যতম স্রষ্টা অভিজিত্ সরকার। ‘মা অভয়া’, ‘জাগরণ পালা’, ‘ইয়ে’, ‘গণ্ডী’, ‘নগরকীর্তন’, ‘ব্রেখটের খোঁজে’, ‘ঈশ্বর এসেছেন’ সহ নানা নাটক ও সক্রেটিসকে নিয়ে কৌশিকের যে সুগভীর চিন্তা ছিল, সে কথা তুলে ধরেন ছান্দিকের কর্ণধার শক্তিনাথ ভট্টাচার্য। স্মরণ পুস্তিকায় নান্দীকারের কর্ণধার রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত লিখছেন, ...এরকম ঝকঝকে ছেলে, বিএ, এমএ দুটোতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্স্ট হয়েছে, সে রকম ছেলে তো চট করে থিয়েটারে আসে না। তারা তো কেরিয়ার তৈরি করতে চলে যায়। এখন আমার আফসোস হচ্ছে, আমার ভালবাসায় কী অভাব হল যে আমি তাকে ধরে রাখতে পারলাম না।”
গৌতম হালদার স্মৃতিকথায় জানান মেঘনাদ বধ কাব্য নাটকে পরিণত করার পিছনে কৌশিকের অবদানের কথা। গৌতম লিখছেন, নাগেরবাজারে তখন থাকত ও। ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্য নাটকে প্রয়োগ হতই না, যদি সেই সময় শ্যামবাজারে নান্দীকারের মহলা কক্ষের বাইরে ওয়ার্কশপ চলার ফাঁকে চা খেতে খেতে কৌশিক মেঘনাদ বধ থেকে আবৃত্তি না করত।
প্রেসিডেন্সি, দার্জিলিং গভর্নমেন্ট কলেজ, বারাসত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলকাতার গোয়েঙ্কা কলেজ-সহ নানা প্রতিষ্ঠানের কৃতী অধ্যপক কৌশিক একাধারে ছিলেন কবি, ‘সিনেমা ভাবনা’ পত্রিকার কর্ণধার, প্রাবন্ধিক, চিত্রশিল্পী, বাচিকশিল্পী, নাট্যকার এবং নির্দেশক। পরিচালক সীমা সরকার তাঁর স্মৃতিচারণায় জানান, নাট্যশিল্পের সর্বত্র ছিল কৌশিকের অবাধ অধিকার। ‘কৌশিক কারও একার নয়, কৌশিক সবার।’ এই সত্যকথনের ছন্দপতন হয়েছে দু’টি অনুষ্ঠানেই ‘রৌরব’ প্রসঙ্গ অনুল্লেখে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পসত্তা তৈরির কালপর্বে কৌশিকের মনন ও চর্চা অনেকটা শানিত হয়েছে অধুনালুপ্ত সাহিত্যগাষ্ঠী ‘রৌরব’-এর সান্নিধ্যে। সে কথাটা কোনও সভাতেই স্মরণ চর্চায় উঠে এল না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy