Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

জীবন বদলাতে ভোট ওপারের বাসিন্দাদের

ভুল করে ভোটার কার্ড না নিয়ে পঞ্চায়েতের পরিচয়পত্র নিয়ে কাঁটাতারের এ পারে চলে এসেছিলেন বছর সত্তরের মমিনা বিবি। কিন্তু তা দেখিয়েও যে ভোট দেওয়া যাবে না। অগত্যা ভোটার কার্ড আনতে ফের কাঁটাতার পেরিয়ে ফিরে গেলেন বাড়িতে। কিন্তু তাতেও বৃদ্ধার কোনও ক্লান্তি নেই।

কাঁটাতারের ওপার থেকে ভোট দিতে আসছেন হুদোদিগম্বরপুরের বাসিন্দারা। —নিজস্ব চিত্র।

কাঁটাতারের ওপার থেকে ভোট দিতে আসছেন হুদোদিগম্বরপুরের বাসিন্দারা। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কৃষ্ণগঞ্জ শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:০৪
Share: Save:

ভুল করে ভোটার কার্ড না নিয়ে পঞ্চায়েতের পরিচয়পত্র নিয়ে কাঁটাতারের এ পারে চলে এসেছিলেন বছর সত্তরের মমিনা বিবি। কিন্তু তা দেখিয়েও যে ভোট দেওয়া যাবে না। অগত্যা ভোটার কার্ড আনতে ফের কাঁটাতার পেরিয়ে ফিরে গেলেন বাড়িতে। কিন্তু তাতেও বৃদ্ধার কোনও ক্লান্তি নেই। যত কষ্টই হোক ভোট যে তাঁকেই দিতে হবে। প্রতিবারই ভোট এলে কাঁটাতারের পেরিয়ে হুদোদিগম্বরপুরের মুসলিমপাড়ার ৪০টি পরিবারের মোট ১০৪ জন ভোটার ভোট দেন। প্রতিবারই ভাবেন এ বার হয়তো জীবনের চাকা ঘুরবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত পরিস্থিতির বদলায়নি। আশা তবু তাঁরা ছাড়তে পারেন না।

২০০২ সালে ওই গ্রামের মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছিল কাঁটাতারের বেড়া। যাঁদের পয়সা বা জমি ছিল তাঁরা চলে আসেন কাঁটাতারের এপারে। আর যাঁদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয় তাঁদের ঠাঁই হয়েছিল কাঁটাতারের ওপারে। ভারতের বাসিন্দা হয়েও তাঁরা হয়ে গেলেন নিজভূমে পরবাসী। সংখ্যায় ৪০টি পরিবার। প্রতিদিন হাজার প্রতিকূলতার সঙ্গে যুঝতে যুঝতে এগিয়ে চলে তাঁদের জীবন। কখনও মাথাভাঙা নদী পেরিয়ে এসে দুষ্কৃতীরা লুঠ করে নিয়ে যাচ্ছে সর্বস্ব। কখনও সেচের অভাবে নিষ্ফলা হয়ে পড়ে রয়েছে জমি। তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হল বিকেল সাড়ে ৫টায় গেট বন্ধ হয়ে যাওয়া। তখন সারা পৃথিবী থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তাঁরা।

তাই নিজেদের জীবন বদলানোর আশায় সকাল থেকে তাই ভোটার কার্ড হাতে নিয়ে চলে এসেছেন এপারে। তারপর প্রায় দু’কিলোমিটার উজিয়ে স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলের বুথে ভোট দিয়ে ফিরে গেলেন গ্রামে। গ্রামেরই বাসিন্দা জটিরবক্স মণ্ডল জানান, বাধ্য হয়ে তাঁদেরকে ওপারে থাকতে হয়। সারাক্ষণ সিঁটিয়ে থাকতে হয় বাংলাদেশি আক্রমণের ভয়ে। “প্রতিবার ভোট এলে ভাবি এবার বুঝি আমাদের জীবনে পরিবর্তন আসবে। কিন্তু আজও কোনও কিছু হল না”আপেক্ষ তাঁর।

ভোট দিতে আসা সরাবউদ্দিন মণ্ডল বলেন, “নিজদেশে পরবাসি হয়ে আছি।” তাহলে এপারে আসছেন না কেন সেই প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, কাঁটাতারের এপারে তাঁদের কোনও জমি নেই। জমি কিনে বাস করার মতো টাকাও নেই। তাঁর কথায়, “সরকার জমি দিলে কবেই চলে আসতাম এপারে।” সরকার একদিন জমি দেবে, পুনর্বাসন দেবে সেই স্বপ্ন আজও দেখেন হুদোদিগম্বরপুরের বাসিন্দারা। প্রতিবারই ভাবেন জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের একটা হিল্লে করবেন । সেই বিশ্বাসটুকু আঁকড়ে ধরে তাঁরা ভোট দেন।

নদিয়ায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের ওপারে এমন অনেক গ্রাম রয়েছে যেখানকার বাসিন্দারা বিশ্বাস করেন ভোট দিলে হয়তো তাঁদের সমস্যার মিটবে। এমনই আরও এক গ্রাম বিজয়পুর। যার একাংশ রয়েছে কাঁটাতারের ওপারে। ২৮৫টি পরিবার মিলিয়ে ৮৭৩ ভোটার রয়েছেন। ভারতের অন্যান্য প্রান্তের মতো তাঁরাও সমান উৎসাহ নিয়ে ভোট দেন। অন্তত ভোটের দিনটা তাঁদের কাছে অন্যরকম মনে হয়। গ্রামের বাসিন্দা বিজন বিশ্বাস বলেন, “আমরা যাঁরা কাঁটাতারের ওপারে থাকি তাঁদের জীবনযন্ত্রনা দেশের অন্য প্রান্তের মানুষের ঠিক বুঝতে পারেবন না।” তাঁর কথায়, “প্রতি মুহূর্তে ভয় হয় এই বুঝি মাথাভাঙা নদী পার হয়ে খেতের ফসল লুঠ করে নিয়ে গেল দুষ্কৃতীরা।” তিনি জানান, দীর্ঘদিন বন্ধ হয়ে আছে রিভার পাম্প। তাই সেচের অভাবে পড়ে রয়েছে জমি। প্রশাসনিক স্তরে বার বার প্রতিশ্রুতি মিললেও বাস্তবে কিছু হয়নি। তাই পর দিন কী খাবেন সেই চিন্তায় রাতে ঘুম ছুটে যায় তাঁদের।

তবু তাঁরা ভোট দেন। ভোট দেন জীবন বদলানোর আশায়। বার বার। তাই এবারও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

krishnaganj by election bjp tmc
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE