Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

তালাকের পরেও লড়াইয়ে মেয়েরা

তিন সন্তান জন্মানোর পরে বেলডাঙার টগর খাতুনকে ‘তালাক’ দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয় স্বামী। গোড়ায় মামার বাড়িতে আশ্রয় নিলেও, পরে কাজের সন্ধানে দিল্লি পাড়ি দেয় টগর। অচিরে টের পায়, পরিচারিকার কাজ দেওয়ার নামে তাকে পাচারের চেষ্টা চলছে। কোনও মতে আড়কাঠিদের নাগাল এড়িয়ে বাড়িতে ফেরে টগর।

শুভাশিস সৈয়দ
বহরমপুর শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৫ ০২:৫৪
Share: Save:

তিন সন্তান জন্মানোর পরে বেলডাঙার টগর খাতুনকে ‘তালাক’ দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয় স্বামী। গোড়ায় মামার বাড়িতে আশ্রয় নিলেও, পরে কাজের সন্ধানে দিল্লি পাড়ি দেয় টগর। অচিরে টের পায়, পরিচারিকার কাজ দেওয়ার নামে তাকে পাচারের চেষ্টা চলছে। কোনও মতে আড়কাঠিদের নাগাল এড়িয়ে বাড়িতে ফেরে টগর।

রানিনগর থানার ঠাকুরপুরের সারভানু খাতুনের বিয়ে হয় ১২ বছর বয়সে। বিয়ের পরেই পণের জন্য মারধর শুরু করে স্বামী। পণ দিতে না পারায় একদিন বাড়িতে লোকজন ডেকে তালাক দিয়ে দেয়। পরিবারের লোক ফের যার সঙ্গে বিয়ে দিল, সারভানু তার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। চার মাস পরে সারভানুকে তালাক দিয়ে স্বামী ফের তার প্রথম স্ত্রীকে বাড়িতে নিয়ে আসে। এখন সেলাই মেশিনের কাজ করে সংসার চালায় সারভানু।

হরিহরপাড়ার জ্যোত্‌স্না খাতুন স্বামীর চিঠি ভেবে ডাকপিয়নের কাছ থেকে চিঠি নিয়ে খাম খুলতেই দেখে, আসলে তা তালাকনামা। স্বামী অন্যত্র বিয়ে করেছে। সন্তান নিয়ে বাবার বাড়িতেই থেকে যান জ্যোত্‌স্না। পরে বাড়িতে ফিরে নিজের চেষ্টায় জ্যোত্‌স্না খাতুন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেন। তাঁর একমাত্র সন্তান এখন একাদশ শ্রেণির ছাত্র। তাঁর কথায়, “মাথা উঁচু করে বাঁচতে হবে। তাই আমি নিজে পড়ব। ছেলেকেও শিক্ষিত করে তুলব।”

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে এমনই কয়েকশো মহিলাকে নিয়ে বহরমপুরে একটি অনুষ্ঠান করে রোকেয়া নারী উন্নয়ন সমিতি। সংস্থার কর্ণধার খদিজা বানুুু বলেন, “মুর্শিদাবাদ জেলায় তালাকপ্রাপ্ত, স্বামী-পরিত্যক্তা মেয়েদের সংখ্যা লক্ষাধিক। কাজের সন্ধানে বেরিয়ে তাঁদের অনেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে।” খদিজার আক্ষেপ, সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই জেলা নারী পাচারে শীর্ষ স্থানে। তাঁর অভিযোগ, ওয়াকফ বোর্ড, সংখ্যালঘু দফতর বা স্থানীয় পঞ্চায়েত থেকে এই মেয়েদের কোনও সাহায্য মেলে না। এমন স্বামী পরিত্যক্তা মেয়েদের জন্য সরকারের কোনও বিশেষ প্রকল্পও নেই। নিজেদের চেষ্টায় এই মেয়েরা কেউ সেলাই করে রোজগার করে, কেউ স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে মুদিখানার দোকান চালায়।

সেদিন সভায় নিজেদের কঠিন জীবনের কথা বলতে বলতে অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। আবেগে গলা বুজে আসে কারও কারও। তাঁদের অনেকেরই প্রশ্ন, মেয়েদের আইনি সুরক্ষা কী রয়েছে? বাড়িতে স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও কোনও পুরুষ যখন দ্বিতীয় বিয়ে করছে, তখন মেয়েরা কেন নিজেদের অধিকার সুরক্ষিত করতে পুরুষের বিরুদ্ধে কোনও আইনি পদক্ষেপ করতে পারে না?

বহরমপুর বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবু বাক্কার সিদ্দিকি বলেন, মুসলিম পার্সোনাল ল-এ তালাক প্রথা রয়েছে। কী ভাবে তালাক দেওয়া যায়, তার উল্লেখও রয়েছে। “কিন্তু সচেতনতার অভাবে গ্রামগঞ্জে তিন তালাক দেওয়া হয়। বহু ক্ষেত্রে এটা বৈধ নয়। ফলে ওই মহিলাদের আইনি রক্ষাকবচ আছে,” বলেন তিনি।

খদিজা বানু অবশ্য স্পষ্টই বলেন, ভারতে মুসলিম তালাকপ্রাপ্ত মেয়েদের আইনি সুরক্ষা পাওয়া কঠিন। কারণ, ভারতে মুসলিম পার্সোনাল ল পুরুষদের একাধিক বিয়ে নিষিদ্ধ করেনি। সম্পত্তিতে মুসলিম মেয়েদের সমানাধিকারও দেওয়া হয়নি। এমনকী নিঃসন্তান মেয়েদের তাদের পিতার সম্পত্তিতে সম্পূর্ণ অধিকার নেই। “আইন ভারতীয় মুসলিম মেয়েদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না,” বলেন খদিজা। “আমরা আইনি সুরক্ষার দাবিতে সোচ্চার হয়েছি।”

মুর্শিদাবাদের প্রায় পাঁচ হাজার বঞ্চিত, প্রান্তবাসী মেয়েদের নিয়ে কাজ করে রোকেয়া নারী উন্নয়ন সমিতি। খদিজা জানান, আইনত তালাকের পর মুসলিম মেয়েরা খোরপোশ দাবি করতে পারে, কিন্তু বাস্তবে তা প্রায় করাই যায় না। এক কি দুই শতাংশ মেয়ে আদালতে আবেদন করে খোরপোশ পাচ্ছে। তিনি বলেন, “আমাদের সদস্য বহু মেয়ে দশ-এগারো বছর আদালতে ঘুরেও খোরপোশ আদায় করতে না পেরে হারিয়ে গিয়েছে।” জেলায় লক্ষাধিক তালাকপ্রাপ্ত, পরিত্যক্তা মেয়ে থাকার জন্যই মুর্শিদাবাদ রাজ্যে নারী পাচারে শীর্ষে, দাবি করেন খদিজা।

কী ভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে টগর, জ্যোত্‌স্নার মতো মেয়েরা? “আমরা বিভিন্ন ব্লকে এই মেয়েদের পঞ্চায়েতের নানা প্রকল্পের অধীনে ঋণ, প্রশিক্ষণ দেওয়ার চেষ্টা করি। ছ’টা ব্লকে সেলাই মেশিনও দিই। যদিও এই সবই প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম,” জানান খদিজা। এ বছর থেকে মেয়েদের বিনামূল্যে আইনি পরিষেবা এবং চিকিত্‌সার ব্যবস্থা শুরু করার চেষ্টা করছে রোকেয়া নারী উন্নয়ন সমিতি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

shubhashis sayed berhampur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE