সে দিনও ছিল বসন্তের পূর্ণিমা। সোনার থালার মতো একটি চাঁদ উঠেছিল। হয়েছিল চন্দ্রগ্রহণও। সেই সন্ধ্যায় জন্ম জগন্নাথ মিশ্রের পুত্র বিশ্বম্ভরের। পরে যিনি জাহ্নবী, জনপদ, জায়া ও জননীর হাত ছেড়ে চলে যাবেন সংসার থেকে দূরে। নাম হবে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য।
কিন্তু তখনও বড় দারুণ ছিল এ বসন্ত। তখনও ফাগুন ছিল। ছিল ‘কোইল বাণী’। সেই নবীন সন্ন্যাসী তখন ‘হরি মুখে’ আশ্রয় খুঁজতেন। সন্ন্যাসের পরেও তিনি পছন্দ করতেন বিদ্যাপতির পদ। তেমনই একটি পদ এখনও গীত হয় দুধ সাদা জ্যোৎস্নায় ভরা নবদ্বীপের মঠে--‘দারুণ বসন্ত যত দুখ দেল। হরি মুখ হেরাইত সব দূর গেল। কি কহব রে সখি আনন্দ ওর। চিরদিন মাধব মন্দির ওর।’
এখন নবদ্বীপে গঙ্গার ধারে আকাশ ছোঁয়া মন্দিরের চুড়ো বেয়ে গড়িয়ে পড়া ফাল্গুনি জ্যোৎস্নায় যেন থই থই করে চারপাশ। শতাব্দী প্রাচীন কোনও মন্দির থেকে একই সঙ্গে ভেসে আসে সুগন্ধ আর সুর। আবীর কুমকুম গোলাপজলের সঙ্গে মেশে ধূপের গন্ধ। ভিতরের কীর্তনের আসর থেকে ভেসে আসা জয়জয়ন্তীর সুর। সাদা মার্বেল মোড়া বিরাট নাটমন্দিরে একদিকের উঁচু বেদিতে রুপোর সিংহাসনে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি গোলাপে গোলাপে গিয়েছে ঢেকে। তার সামনে কীর্তনিয়া সুরেলা কণ্ঠে গাইছেন, ‘নিরখত বয়ান নয়ন পিচকারি, প্রেম গুলাব মন হি মন লাগ/ দুহুঁ অঙ্গ পরিমল চুয়া চন্দন ফাগু/ রঙ্গ তহি নব অনুরাগ।’ অংশটি বার বার গাইতে গাইতে কীর্তনিয়া তাতে আখর জুড়লেন, ‘তখন নয়ন পিচকারি হল, অনুরাগের রঙে ভরা নয়ন পিচকারি হল।’ মৃদঙ্গ দ্বিগুন থেকে চৌগুনে। আপ্লুত শ্রোতাদের সাধুবাদে, উলুধ্বনিতে ডুবে গেল কীর্তনের সুর। বিগ্রহের সামনে রাখা পাত্র থেকে মুঠো মুঠো আবীর উড়তে লাগল। বসন্ত আওল রে।
বৈবষ্ণবদের ভজন কুঠিরে বসন্ত এ ভাবেই আসে। মাঘের শ্রীপঞ্চমীর সন্ধ্যা থেকেই বসন্তোৎসবের সূচনা হয় নবদ্বীপের মঠ মন্দির গুলিতে। তারপর ফাল্গুনি পূর্ণিমা পার করে সেই চৈত্র পূর্ণিমার রাতে বসন্ত রাসে তার পরিসমাপ্তি। প্রায় দু’মাস ধরে চলা এই বৈষ্ণবীয় বসন্তোৎসবের মূল উদ্দেশ্য হল ভক্তের সঙ্গে ভগবানকে মিলিয়ে দেওয়া। আবির, কুমকুম, রঙের আড়ালে ভক্ত আর ভগবানের মধ্যে এই সেতুবন্ধটি গড়ে তোলা।
আর এ দিনই তো মহাপ্রভুর অন্নপ্রাশনের উৎসবও। এই উৎসবের শুরু ঠিক কবে থেকে, তা নিয়ে কোন পাথুরে প্রমাণ নেই। যেমন জানা যায় না, কী ভাবে নবদ্বীপে চৈতন্যদেবের আবির্ভাব তিথি আন্তর্জাতিক উৎসবে বদলে গেল। ইতিহাস বলে প্রধানত পশ্চিম ভারতের উৎসব ‘হোলি’ বঙ্গদেশে এসেছিল সেন রাজাদের আমলে। চৈতন্যদেব পরে দোলকে নতুন ভাবে সাজান। নৃত্য, গীত, কীর্তন, পদযাত্রায় উৎসবের ছোঁয়া লাগল দোলে। আবির,কুমকুমে দোল হয়ে উঠল রঙের উৎসব। ১৮ শতকের শেষ এবং উনিশ শতকের গোড়ার দিকে দোল হয়ে উঠল সেকালের বড়লোকদের উৎসব। উদ্দাম আমোদে তাঁরা দোলে মেতে উঠতেন।
তবে মহাপ্রভু বাড়ীর উৎসবে আড়ম্বরের ছোঁয়া লাগে একশো বছর আগে শচীনন্দন গোস্বামীর সময়ে। মহাপ্রভুর সেবাইত গোস্বামীদের মতে অন্নপ্রাশনের দিন তিনি আর যুগাবতার শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নন। তিনি ওই দিন জগন্নাথ মিশ্র ও শচীদেবীর কোল আলো করা আদরের ধন নিমাই বা বিশ্বম্ভর। আর তাই নিমাইয়ের অন্নপ্রাশনে ঝিনুক-বাটি থেকে ঝুমঝুমি, চুষিকাঠি থেকে খেলনা বাদ থাকে না কিছুই। চৈতন্যদেবের জীবৎকালেই বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী বংশীবদন ঠাকুরের সহায়তায় নবদ্বীপে নিজগৃহে নির্মাণ করিয়ে ছিলেন এই বিগ্রহ। অনিন্দ্য সুন্দর এই বিগ্রহকে এ দিন পড়ানো হয় লাল চেলি, পায়ে মল।
বলা হয় শ্রীকৃষ্ণের জন্মের পর নন্দরাজ যে ভাবে উৎসব করেছিলেন, নিমাই এর জন্মের পর জগন্নাথ মিশ্রও একই ভাবে উৎসব করেছিলেন। তাই এই অন্নপ্রাশন উৎসবের আর এক নাম, ‘জগন্নাথ উৎসব’। গোস্বামীরা জানান, তাঁরা ছাড়া ভূ-ভারতে আর কেউ মহাপ্রভুকে অন্নপ্রাশন দেওয়ার অধিকারী নন। থরে থরে সাজানো ভোগের আগে মহাপ্রভুর নামকরণ, চূড়াকরন সবই হয়। দাদামশাই নাম রেখেছিলেন বিশ্বম্ভর। এদিনও প্রতীকী নামকরন করা হয়। তারপর ভোগ নিবেদন। অন্নপ্রাশনের দিনে মহাপ্রভুকে অন্নব্যঞ্জন পরিবেশন করা হয় মহামূল্য পাত্রে। রুপো, তামা, কাঁসা এবং পিতল এই চার ধরনের পাত্রে সাজানো হয় পদগুলি। হাত ধোয়ার ডাবর, গাড়ু, ধুপদানি, কোষাকুষি সবই এদিন রুপোর। আর ঝুমঝুমি, চুষিকাঠি, মল-এসব সোনার।
মহাপ্রভুর অন্নপ্রাশনের মেনুতে কী কী থাকে তা বলার থেকে কী থাকে না, এটা বলা তুলনায় সহজ। তবে তরকারি, ডাল, শুক্তো, ভাজা, পোস্ত, শাক এবং চাটনি থাকবে সাত রকমের। সঙ্গে মহাপ্রভুর প্রিয় থোড়, মোচা, কচুর শাক, বেগুনপাতুরী, ছানার রসা (ডালনা), ধোকার ডালনা, লাউ, চালকুমড়ো থাকবেই। পোস্ত দিয়ে যত রকমের পদ সম্ভব, এমন কি ছানার পোস্তও। কুল, তেঁতুল, আম, আমড়ার টক। তবে মহাপ্রভুর ভোগে নিষিদ্ধ টম্যাটো, পুঁইশাক এবং মুসুর ডাল।
তবে শুধু উৎসবের দিন বলে নয় বছরের ৩৬৫ দিনই মহাপ্রভুর ভোগের জন্য নানারকম উপাদেয় পদের ব্যবস্থা থাকে। প্রতিদিন ভোর ৫টায় নিদ্রাভঙ্গের পর হয় শৃঙ্গার। দেওয়া হয় বাল্যভোগ। থাকে মাখন, মিছরি, ক্ষীর এবং মিষ্টি। সকাল ৯ টায় অর্চন। তখন দেওয়া হয় ডাবের জল, মিষ্টি, ফল। দুপুর ১২ টায় মধ্যাহ্নভোগ। অন্ন, শাক, শুক্তো, ডাল, তরকারি। সঙ্গে মহাপ্রভুর প্রিয় থোড়, মোচা, কচুর শাক, চাটনি, পরমান্ন। বিকেল পাঁচটায় উত্থান ভোগ। ছানা, মিষ্টি, মরসুমি ফল, সরবত। রাত ৯টায় শয়ন ভোগ। লুচি, মালপোয়া, হলুদ ছাড়া রান্না করা সবজি, ক্ষীর, সুজি, মিষ্টি। তবে মহাপ্রভুর অন্নপ্রাশনের ভোগে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী পদ হল রসগোল্লার চাটনি। নিজস্ব রেসিপিতে এই পদ রান্না করেন গোস্বামী পরিবারের প্রবীণারা। মহাপ্রভু মন্দিরের রান্নাঘরে তৈরি রসগোল্লা দিয়ে প্রস্তুত হয় এই বিশেষ পদটি। তবে ঠিক কী ভাবে রসগোল্লার চাটনি রান্না করা হয়, সেটা গোস্বামিদের একেবারেই টপ সিক্রেট।
—নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy