Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

শুদ্ধ বসন্তে গাওয়া হয় নবদ্বীপের বসন্ত কীর্তন

ফুলমালায় সাজানো দক্ষিণদুয়ারি সিংহদরজার উপরে নহবতখানা সানাইয়ে ‘বৃন্দাবনী সারং’। রাগের আলাপের রেশ ঘন জনবসতির ছাদ, ব্যালকনি পেরিয়ে অলস দুপুরে গৃহস্থের অন্দরমহলের পৌঁছে দেয় উৎসবের সুর। নাটমন্দিরে উত্তরমুখী গরুড় স্তম্ভের নীচে ব্যান্ডপাইপে পদাবলী কীর্তনের সুর আর গর্ভমন্দিরের বন্ধ দরজার সামনে জড়ো হওয়া হাজার হাজার ভক্ত কন্ঠ মিলিয়ে গাইছেন, “জয় শচীনন্দন জয় গৌরহরি / বিষ্ণুপ্রিয়া প্রাণনাথ নদিয়াবিহারী।”

নবদ্বীপে মহাপ্রভূর বাড়িতে চলছে অন্নপ্রাশন ভোগের প্রস্তুতি। —নিজস্ব চিত্র।

নবদ্বীপে মহাপ্রভূর বাড়িতে চলছে অন্নপ্রাশন ভোগের প্রস্তুতি। —নিজস্ব চিত্র।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৫ ০১:১২
Share: Save:

ফুলমালায় সাজানো দক্ষিণদুয়ারি সিংহদরজার উপরে নহবতখানা সানাইয়ে ‘বৃন্দাবনী সারং’। রাগের আলাপের রেশ ঘন জনবসতির ছাদ, ব্যালকনি পেরিয়ে অলস দুপুরে গৃহস্থের অন্দরমহলের পৌঁছে দেয় উৎসবের সুর। নাটমন্দিরে উত্তরমুখী গরুড় স্তম্ভের নীচে ব্যান্ডপাইপে পদাবলী কীর্তনের সুর আর গর্ভমন্দিরের বন্ধ দরজার সামনে জড়ো হওয়া হাজার হাজার ভক্ত কন্ঠ মিলিয়ে গাইছেন, “জয় শচীনন্দন জয় গৌরহরি / বিষ্ণুপ্রিয়া প্রাণনাথ নদিয়াবিহারী।” ভক্ত যে তার ভগবানকে নিজের মতো করেই দেখতে চায়। তাই সে চৈতন্যকে জননী ও জায়া রূপে কল্পনা করে।

নবদ্বীপের চৈতন্য আবির্ভাব উৎসবের প্রধান আকর্ষণ কিন্তু কীর্তন। বসন্ত ঋতুতে এবং প্রধানত বসন্ত রাগে গাওয়া হয় তাই এর নাম বসন্তকীর্তন। পরিচিত কীর্তন থেকে বেশ খানিকটা আলাদা। গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের বসন্ত এই বিশেষ কীর্তনের সুর ছাড়া ভাবাই যায় না। পণ্ডিতেরা বলছেন, আদিতে রাধাকৃষ্ণের বসন্তকালীন লীলা এবং উপাসনা অঙ্গের বিভিন্ন গান ছিল বসন্তকীর্তনের মূল বিষয়বস্তু। পরবর্তী সময়ে দোল পূর্ণিমা তিথিতে চৈতন্যদেবের জন্ম, আবার তিনি সন্ন্যাসও নিলেন এমনই এক বসন্তে। তাই এগুলিও বসন্তকীর্তনের উপজীব্য।

কীর্তন সম্রাজ্ঞী উপাধি প্রাপ্ত সরস্বতী দাস বলেন, “কীর্তনের নানা রকমফের আছে। তার মধ্যে কোন বিশেষ পার্বণ উপলক্ষে যে কীর্তন গাওয়া হয় তাকে বলে পরব কীর্তন। যেমন রাস, ঝুলন, জন্মাষ্টমীর কীর্তন। বসন্ত কীর্তনও হল তেমনই এক ধরনের পরব কীর্তন। এই কীর্তন প্রধানত বসন্ত রাগে গাওয়া হয় এবং অবশ্যই বসন্তকালে, দোলের আগে পরে।” নবদ্বীপের বিভিন্ন মন্দিরে তিথি নক্ষত্র পঞ্জিকা মেনে, ঋতু অনুযায়ী রাধাকৃষ্ণের নিত্যসেবা হয়। গোটা শীতকাল জুড়ে গরম জলে বিগ্রহের সেবা হয়, কিন্তু শ্রীপঞ্চমীর বা বসন্তপঞ্চমীর দিন থেকে শীতের বিদায় ধরে নিয়ে শুরু হয় বিগ্রহকে চামর দিয়ে বাতাস করা। তাই বসন্তের আগে চামর দুলায় নরহরি এই ধরনের আরতির পদ গাওয়া ঠিক নয় বললেন কীর্তনীয়ারা।

সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত শুভেন্দুকুমার সিদ্ধান্ত বলেন, “বৈষ্ণবদের কাছে বসন্ত মানে একদিকে যেমন শ্রীকৃষ্ণের হোরি বা দোল, তেমনই চৈতন্যদেবের জন্মোৎসবও। দু’টি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব একই সময়ে উদযাপন করা হয়। আর বৈষ্ণব উৎসব মানেই সুর ও বাণীর যুগলবন্দী। মহাজন পদকর্তারা সুপ্রাচীন কাল থেকে বসন্তোসবের জন্য রচনা করেছেন অসামান্য সব পদাবলি। পাশাপাশি চৈতন্য পরবর্তী যুগে মূলত নরোত্তম দাস ঠাকুরের হাত ধরে এল চৈতন্য বিষয়ক পদ, যেগুলি হোরি কীর্তনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে উঠল।” শুভেন্দুবাবু জানান রাজশাহী জেলার গরানহাট পরগনার খেতুরি গ্রামে নরোত্তম দাস একটি মহোৎসব করেন এবং সেখান থেকে কীর্তনের নতুন একটি ধারার জন্ম হয়। যা গরানহাটি ধারা নামে পরিচিত। সেখানে তিনি বসন্তকীর্তন বা হোরিকীর্তনের জন্য যেমন বসন্ত, জয়জয়ন্তী, শ্রী, গুর্জরী বা কেদারের মতো ঋতু প্রধান রাগের ব্যবহার করেছেন, তেমনই তালের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন ছন্দ প্রধান তাল, যাতে একটা মাতন বা দোলা আছে। তিনি বলেন, “সাতমাত্রার চঞ্চুপুট তালের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োগ করেছেন হোরি তাল, ধামার তাল প্রভৃতি। আর এসবই করা হয়েছে বসন্ত কীর্তনকে আকর্ষণীয় করে তুলতে।”

কীর্তন নিয়ে দেশ বিদেশ চষে বেড়ানো কীর্তনীয়া সুমন ভট্টাচার্য বলেন, “গোবিন্দদাস থেকে জয়দেব হয়ে বাসুদেব ঘোষ সমস্ত পদকর্তাদের পদে বসন্ত একটা আলাদা মর্যাদা পেয়েছে। ফলে বসন্তকীর্তন খুব সমৃদ্ধ। কথা এবং সুরের আশ্চর্য মেলবন্ধন ঘটেছে এখানে। ‘শিশিরক অন্তে আওয়ে বসন্ত’গোবিন্দদাসের এই পদটিকে বসন্তের আগমনী ধরা হয়। ‘আওত রে ঋতুরাজ বসন্ত/ খেলত রাই কানু গুণবন্ত/ তরুকুল মুকুলিত অলিকুল ধাব/ মদনোমহোৎসবে পিককুল রাব’ জ্ঞানদাস রচিত এই পদটি নিশ্চিত ভাবেই রাধাকৃষ্ণের বসন্তোৎসবের উদ্বোধনী। এই সব পদ ছাড়া বসন্তকীর্তন ভাবাই যায় না।” তিনি জানান, জয়দেবের গীতগোবিন্দের সম্পূর্ণ লীলাটি বসন্ত কেন্দ্রিক। সেখানে মোট ২৪টি গান আছে বারোটি ভিন্ন ভিন্ন রাগে। বসন্ত রাগে আছে তিনটি গান।

কীর্তন বিশেষজ্ঞ সুমনবাবু বলেন, “আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে বসন্ত রাগ একাধিক। তবে কীর্তনে যে বসন্ত রাগ গাওয়া হয়, সেটি শুদ্ধ বসন্ত। পরজ বসন্তের প্রয়োগ সাধারণত কীর্তনে হয় না। তা ছাড়া হিন্দোল বা সকালের দিকে গুর্জরী বিকেলের দিকে গৌরী, দেশবরাড়ি রাগেও গাওয়া হয়। এমনকী অবিরল রঙের ধারাস্নান বর্ষার আবেশ আনে বলে বসন্তকীর্তনে মল্লারও ব্যবহার হয়।” বৈষ্ণবেরা এ ব্যাপারে ভীষণ সতর্ক, বহু কীর্তন আছে যার সুর ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে বদলে যায়, অথচ পদটা একই থেকে যায়। যেমন মহাপ্রভুর আরতি কীর্তনের বিখ্যাত পদ ভালি গোরাচাঁদের আরতি বনি শ্রীপঞ্চমী থেকে চৈত্রপূর্ণিমা পর্যন্ত বসন্ত রাগে গাওয়া হয়। বসন্ত বিদায় নিলেই সুরও যায় বদলে।

নবদ্বীপের গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের সম্পাদক অদ্বৈত দাস বলেন, “এখনও সমাজবাড়িতে পুরো সময় ধরে নিখুঁত বসন্তোৎসব পালন করা হয়। অন্যত্র একাদশী থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত উদযাপন হয়। একাদশীর দিন অভিসার, দ্বাদশীর দিন আবির খেলা, ত্রয়োদশীর দিন গোলাপজলে রঙ খেলা, চতুর্দশীর দিনও রঙ খেলা। সঙ্গে নানা রসপ্রসঙ্গ এবং পূর্ণিমার দিন হোরিখেলা শেষ হয় রাস নৃত্যে। প্রতিদিনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ধরনের কীর্তন।” দোলপূর্ণিমার সন্ধ্যায় গঙ্গার তীর ঘেঁষা সরস্বতী দাসের ছোট ভজনকুটির নিকানো উঠোনে বসন্তকীর্তনের আসরে কীর্তন রসভারতী গলা দিলেন, গাওত কত রস প্রসঙ্গ বাওত কত বীণ। তারপর আখর দিলেন, মৃদঙ্গ বাজছে তা তা থুইয়া, তা তা থুইয়া। বললেন “পূর্ববঙ্গে থুইয়া শব্দের অর্থ রেখে দেওয়া। কৃষ্ণসেবায় অপ্রয়োজনীয় যে সব জিনিস, তা ত্যাগ করে হোরি খেলতে এস। নিজের অন্তর-বাহির কৃষ্ণভক্তির রঙে রাঙিয়ে নেওয়ার কথা বলেন তাঁরা। তারপরে গাইলেন, আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা প্রিয় আমার ওগো প্রিয়।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kirtan nabadwip doljatra
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE