মাটিয়ারি কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠানে সুতো কাটছেন মহিলারা। —নিজস্ব চিত্র।
সুতোয় বাঁধা জীবন। মাকড়সার জালের মতো এক সূক্ষ প্রায় অদৃশ্য সুতোর উপরেই নির্ভর করে ওঁদের জীবন-জীবিকা। ওঁরা মানে তাপসী ঘোষ, সবিতা রায়, মঞ্জু দত্ত, নীলিমা বিশ্বাস, রূপালি প্রামাণিক, মিনতি নন্দী, তপতী কুণ্ডু, গৌরী কুণ্ডুর মতো পঁচিশ থেকে পয়ঁষট্টি বছরের বহু মহিলা। নবদ্বীপের বিভিন্ন এলাকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ওই সব মহিলারা রক্তের সম্পর্কে কেউ কারও আত্মীয় না হলেও একটা বিষয়ে ওঁদের মধ্যে মিল রয়েছে। জীবনে চলার পথটা ওদের মসৃণ ছিল না। বিভিন্ন সময়ে দুর্ভাগ্যের শিকার হয়ে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ওঁরা যখন হেরে যেতে বসেছিলেন তখন এক আশ্চর্য সাদা সুতো ওঁদের শুধু জীবনের মূল স্রোতেই ফিরিয়ে আনেনি, পরস্পরকে বেঁধে রেখেছে এক মানবিক সম্পর্কের বাঁধনে।
ওঁরা ‘কাটুনি’, অর্থাৎ সুতো কাটেন। তবে সাধারণ সুতো নয়। তাঁতশিল্পে বাংলার অহঙ্কার যে মসলিন কাপড়, সেই মসলিন সুতো ওঁদের কোমল হাতেই তৈরি হয়। উৎকৃষ্ট মানের মসলিন শাড়ি বুনতে এখন সর্বোচ্চ ৫০০ কাউন্টের সুতো ব্যবহার করা হয়। মাকড়সার জালের মতো সেই সুতোই তৈরি করেন ওই কাটুনিরা। মহারাষ্ট্র থেকে আসা বিশেষ ধরনের সুভিন কাপাস তুলো থেকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বিশেষ ধরনের চরকায় তৈরি হয় ওই সুতো। ধৈর্য এবং একাগ্রতা এই কাজে প্রধান হাতিয়ার। জানা গিয়েছে, রাজ্যে হাতে গোনা যে কয়েকটি জায়গায় ৪০০ এবং ৫০০ কাউন্টের অতি সূক্ষ মসলিন সুতো তৈরি হয় তার মধ্যে নবদ্বীপ অন্যতম। নবদ্বীপের রাধাবাজারের মাটিয়ারি কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং যোগনাথতলায় নবদ্বীপ কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে শতাধিক মহিলা মসলিন সুতো তৈরি করেন। এই সুতো কাটার কাজ করে স্বনির্ভর হওয়ার পাশাপাশি ওই মহিলারা সামাজিক প্রতিষ্ঠাও পেয়েছেন। এই কাজের সুবাদেই ওঁদের কেউ রাষ্ট্রপতি ভবনের অতিথি হয়েছেন, কেউ মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার নিয়েছেন। জেলা বা ব্লক স্তরে মসলিন সুতোর জন্য সম্মানিত হননি এমন কাটুনি খুব কমই আছেন।
মাটিয়ারি কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষক তাপসী ঘোষের বয়স এখন ৫২ ছাড়িয়েছে। বছর পঁয়ত্রিশ আগের কথা। কাঁসা-পিতল ব্যবসায়ী বাবা হঠাৎ অসুস্থ হওয়ায় ব্যবসা লাটে ওঠে। বাড়িতে তখন মা, অসুস্থ বাবা ও ছোট ছোট পাঁচ ভাইবোন। বাধ্য হয়ে স্কুলের পড়াশোনায় ইতি টেনে উপার্জনের সন্ধানে বেরোতে হয় তাপসীদেবীকে। এলাকার এক বাসিন্দা সন্ধান দিয়েছিলেন খাদির। সব শুনে তাপসীদেবী সোজা চলে যান খাদি প্রতিষ্ঠানে। সেই শুরু। বছর আঠেরোর তাপসী একটু একটু করে শিখলেন কেমন করে তুলো থেকে চরকায় সুতো তৈরি করতে হয়। তাপসীদেবীর কথায়, “নতুনদের নেওয়ার আগে খাদিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আগে কোনওদিন এসব কাজ করিনি। প্রশিক্ষণে আমাকে দেখে ওঁরা প্রথমে বলেছিলেন, ‘একে দিয়ে হবে না’। আমি বলেছিলাম, একবার সুযোগ দিয়ে দেখুন। ঠিক পারব। প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পরে যখন সুতো কাটার কাজ শুরু হল, দেখা গেল আমি প্রতিদিন সব থেকে বেশি সুতো কাটছি।” তিনি জানান, তখন এক লাছি অর্থাৎ এক হাজার মিটার সুতো কাটলে মিলত ৩৫ পয়সা। তখন তিনি কুড়ি লাছি করে সুতো কাটতেন। সেই রোজগারেই সংসারের হাল ধরেছিলেন তাপসীদেবী। এরপর কাজের সুবাদে তিনি দ্রুত নজরে পড়ে যান খাদির তৎকালীন কর্তাদের। আর পাঁচ জন কাটুনির মতো তিনিও শুরু করেছিলেন ১০০ কাউন্টের মোটা সুতো দিয়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সূক্ষ থেকে সূক্ষতর সুতো কাটায় ক্রমশ সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠলেন তাপসী ঘোষ। শেষে তাঁর চরকা থেকে পাওয়া গেল প্রায় অদৃশ্য ৫০০ কাউন্টের মসলিন সুতো। সেই কাজের পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন। ২০০১ সালে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছেন। দৈনিক সাত টাকা মজুরির তাপসীদেবী এখন মাটিয়ারি কুটির শিল্প উদ্যোগের প্রধান প্রশিক্ষক। তিনি বলেন, “এখানে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের সকলের জীবনেই একটা বিপর্যয়ের ইতিহাস আছে। সব কিছু ঝেড়ে ফেলে সম্মানের সঙ্গে ঘুরে দাঁড়াতে এই সামান্য সুতোর শক্তি কী অসামান্য তা কেবল আমরাই জানি।”
নবদ্বীপ পুরসভার গা ঘেঁষে হরিজনপল্লির এঁদো গলির মুখে বসে ছোলা বিক্রি করতেন মঞ্জু দত্ত। সামান্য সেই আয়ে সংসারে নুন আনতে ভাত ফুরিয়ে যেত। এরপর খাদির সুতো কাটার কাজে যোগ দেন তিনি। কয়েক বছরের মধ্যেই ফের সেই অদৃশ্য সুতোর ম্যাজিক। মঞ্জুদেবী ৫০০ কাউন্টের সুতো কাটতে সক্ষম হলেন। এখন তিনি মাসে কয়েক হাজার টাকা রোজগার করেন। স্বনির্ভর হয়ে নিজে বাড়ি করে দিব্যি আছেন মঞ্জুদেবী। একই গল্প পিরতলার বাসিন্দা বছর বাহান্নর সবিতা রায়েরও। বাবা ছিলেন রাজমিস্ত্রি। পাঁচ বোন আর তিন ভাইকে নিয়ে বিরাট সংসার চালাতে হিমসিম খেতেন মা। প্রাথমিকেই লেখাপড়ায় ইতি টেনে বাড়ির বড় মেয়ে হিসেবে মায়ের সঙ্গে সাধারণ তাঁতের সুতো কাটার কাজে হাতেখড়ি। সবিতাদেবী বলেন, “মাত্র ১৫ বছর বয়সেই আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। স্বামী গাড়ি চালাতেন। চার মেয়ে এবং এক ছেলে। ২০০৪ সালে স্বামী মারা গেলে গোটা সংসারের দায়িত্ব নিতে হল আমাকে। সেই সময় খাদিতে যোগ দিই। এখন ৪০০ এবং ৫০০ দুই ধরনের সুতো কাটি। যা রোজগার হয় তাতে চলে যায়।” সবিতাদেবী ইতিমধ্যে শ্রেষ্ঠ কাটুনি হিসেবে নদিয়া এবং মুর্শিদাবাদ জোনে একাধিক পুরস্কার ও মানপত্র পেয়েছেন।
নবদ্বীপ স্টেশন লাগোয়া রেলের জমির ঝুপড়িতে কোনওমতে মাথা গুঁজে থাকতেন নীলিমা বিশ্বাস। দিনমজুর বাবা যখন মারা যান তখন নীলিমার বয়স মাত্র এক বছর। “বাবাকে ভাল মনে নেই। জ্ঞান হয়ে দেখেছি সংসার চালাতে মা লোকের বাড়ি রান্না করতেন। স্কুলে যাওয়া হয়নি। মসলিনের সুতো কাটছি বছর পাঁচেক।” সুতো কাটতে কাটতে বলছিলেন বছর ত্রিশের নীলিমা। তিনি এখন ৪০০ কাউন্ট সুতো কাটেন। সংসারে শ্রী ফিরেছে। শুধু ৫০০ কাউন্ট সুতো কাটা নয়, নীলিমা স্বপ্ন দেখেন মসলিন কাপড় বোনার।
কাটুনিদের কাটা মসলিন সুতো দিয়ে কী ভাবে মসলিন তৈরি হয়? মাটিয়ারি কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা বাহাত্তর বছরের মুরারী চক্রবর্তী জানান, নবদ্বীপ, বর্ধমানের অকালপৌষ এবং শশীনাড়া গ্রামে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তাঁতিরা এই সুতো দিয়েই বোনেন ৫০০ এবং ৪০০ কাউন্টের মসলিন কাপড়। প্রতি মাসে গড়ে দু’হাজার লাছি ফাইন কাউন্ট সুতো তৈরি করেন এই কাটুনিরা। সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে খাদি ও কুটির শিল্পের মেলা এবং প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে রাজ্য সরকার। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে কলকাতায় শুরু হওয়া রাজ্যস্তরের সেই মেলায় প্রতিনিধিত্ব করছেন নদিয়া জেলার শ্রেষ্ঠ কাটুনি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া সবিতা রায় ও মাটিয়ারি কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠানের আর এক কাটুনি ছায়া সাধুখাঁ। জীবন নিয়ে এখন আর তেমন দুশ্চিন্তা নেই রূপালি প্রামাণিক, মিনতি নন্দী, তপতী কুণ্ডুদেরও।
চারপাশের এত ভাঙনের মধ্যেও নীরবে স্বপ্ন বুনে চলেছেন ওঁরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy