জাল: নষ্ট করা হচ্ছে চোলাই মদ। ইসলামপুরে। নিজস্ব চিত্র
বাড়িতে হাজির অতিথি। তাঁর আপ্যায়নে চা, জলের বদলে অধিকাংশ সময়ই এগিয়ে দেওয়া হয় চোলাই।
মালদহের কয়েকটি প্রত্যন্ত গ্রামে এমনই রেওয়াজ, বলছেন সেখানকার বাসিন্দারাই। তাঁদের কেউ কেউ জানাচ্ছেন, চোলাই তৈরি করে বিক্রিকে জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছে অনেকেই। ফলে মালদহ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এই বেআইনি কারবার। যদিও পুলিশ ও আবগারি কর্তাদের দাবি, চোলাইয়ের বিরুদ্ধে লাগাতার অভিযান চালানো হয়।
মালদহের হবিবপুর, বামনগোলা, গাজল, পুরাতন মালদহ, হরিশ্চন্দ্রপুর, চাঁচল-২ ব্লকের বহু গ্রামে বাড়ি বাড়ি তৈরি হয় চোলাই। বহু ক্ষেত্রে বাড়ির মহিলারাই চোলাই তৈরিতে সিদ্ধহস্ত। কী ভাবে তৈরি হয় এই চোলাই? খুব গোপন কোনও বিষয় নয়, গ্রামগুলিতে কান পাতলেই শোনা যাবে চোলাই তৈরির পদ্ধতি। কয়েক জন জানালেন, বড় হাঁড়িতে টানা চার দিন ধরে ভাত রেখে পচানো হয়। তার পরে সেই ভাত গরম করে ফোটানো হয়। তার মধ্যে ‘বাখরের গুলি’ দেওয়া হয়। সেই বাখরের গুলির মাধ্যমেই নেশা হয়। তার পরে ফিল্টারের মাধ্যমে ছেঁকে বোতল বন্দি করা হয়। অনেক সময় ভাতের পরিবর্তে গুড় দিয়েও চোলাই তৈরি হয়। সেই চোলাই গ্রাম থেকে শহর সর্বত্রই হাতবদল হয়ে যায়। এক লিটার চোলাইয়ের পাইকারি দাম পড়ে ৪৫ টাকা। বাজারে তা-ই লিটার প্রতি ৬০ টাকায় বিক্রি হয়।
এই চোলাইয়ের ‘কদর’ নাকি শহরেও রয়েছে। হবিবপুরের চাচাইচণ্ডী গ্রামের এক মহিলা বলেন, “আমাদের তৈরি চোলাই নিতে শহরের মানুষও আসে। সেখানেও এই চোলাই ভাল বিক্রি হয়।” চোলাই তৈরি তো বেআইনি? তিনি বলেন, “কী আর করব! চোলাই বিক্রি করেই আমাদের সংসার চলে।” তখনই কেউ কেউ জানান, বাড়িতে অতিথি এলেও এগিয়ে দেওয়া হয় চোলাইয়ের গ্লাস।
আবগারি দফতরের এক কর্তার দাবি, “বাখরের গুলি আসে ঝাড়খণ্ডের পাকুড় থেকে।” যদিও এর কোনও হাতে গরম প্রমাণ এই মুহূর্তে দেখাতে চান না আবগারি দফতরের লোকজনেরা।
মালদহের অনেক জায়গায় সাধারণ মানুষের অভিযোগ, বহু ক্ষেত্রে প্রকাশ্যেই চোলাই তৈরি ও বিক্রিবাটা হয়। কিন্তু সব দেখেও প্রশাসন নীরব। যদিও পুলিশ ও আবগারি কর্তারা এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁদের দাবি, চোলাইয়ের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালানো হয়। তবে চোলাই সমাজের এক সম্প্রদায়ের মানুষ বেশি পরিমাণে তৈরি করেন। সেই সম্প্রদায়ের মানুষ চোলাই খাওয়াকে উৎসবও মনে করেন। তাই চোলাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হলে তাঁদের হামলার মুখেও পড়তে হয় বলে দাবি প্রশাসনের একাংশের।
মালদহের অতিরিক্ত জেলাশাসক (আবগারি) পালদেন শেরপা বলেন, “অভিযানের পাশাপাশি সচেতনতামূলক প্রচার চালানো হয় মালদহের বিভিন্ন গ্রামে। আগামী দিনে গ্রামের হাটগুলিতেও সচেতনতা মূলক প্রচার চালানো হবে।”
উত্তর দিনাজপুর
উত্তর দিনাজপুর জেলার ইসলামপুর মহকুমায় অলিগলিতে সব ঘুপচি বাড়ি। সেগুলোর মধ্যে চলছে চোলাইয়ের কারখানা। সবই বসতি এলাকা, তাই এ সব জায়গায় অভিযান চালানো কঠিন বলে জানিয়েছেন খোদ আবগারি দফতরের আধিকারিকেরা।
তাঁদের কথায় তো বটেই, স্থানীয় মানুষেরও অভিযোগ, এই জেলার পাঞ্জিপাড়া, ডালখোলা, ইসলামপুর, করণদিঘিতে চোলাইয়ের কারখানা যেন কুটির শিল্পে পরিণত হয়েছে। তমলুক, সংগ্রামপুর, গলসির মতো এলাকায় চোলাই খেয়ে রাজ্যে মৃত্যুর ঘটনার পরেও বদলায়নি এই ছবি।
ডালখোলার দৌলতপুর এলাকায় একই সঙ্গে জাল বিলেতি মদের কারখানাও রয়েছে বলে সম্প্রতি পুলিশের কাছে তথ্য এসেছে। উত্তর দিনাজপুর অতিরিক্ত জেলা পুলিশ সুপার কার্তিক চন্দ্র মণ্ডলের দাবি, ‘‘পুলিশ হাত গুটিয়ে বসে নেই। ডালখোলা, পাঞ্জিপাড়া এবং ইসলামপুরে পাঁচটি এমন ভাটি নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। ছ’মাসে প্রচুর জাল বিলেতি মদ উদ্ধারও হয়েছে।’’
পুলিশেরই একটি সূত্র জানিয়েছে, বিহারে মদ নিষিদ্ধ হওয়ার পর এই এলাকা থেকে জাল মদ বিহারে পাচার শুরু হয়েছে। চোলাইয়ের ব্যবসা ছেড়ে অন্য ব্যবসায় স্বনির্ভর হতে সরকারের তরফে আর্থিক সাহায্য দেওয়া হয় বলেও সেই সূত্রের দাবি। ইসলামপুরে আবগারি দফতরের আধিকারিক রাজর্ষি পাঠক বলেন, ‘‘এখানে বাড়ি বাড়ি চোলাই তৈরি হয়। হাটে সেগুলো বিক্রি হয়।’’ তাঁদের দাবি, রাজ্য সরকার থেকে জাগরণ প্রকল্পের অধীনে ইসলামপুরে ৪৩০ জনকে ইতিমধ্যেই সহায়তা করা হয়েছে। নিয়মিত বোঝানো হচ্ছে চোলাইয়ের খারাপ দিকগুলোও।
পাঞ্জিপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতে তৃণমূলের প্রাক্তন প্রধান লাল মহম্মদের কথায়, ‘‘চোলাই খেয়ে অনেকে সর্বস্বান্ত হয়েছেন।’’ চাকুলিয়ার বিধায়ক আলি ইমরান রমজ (ভিক্টর) বলেন, ‘‘চোলাই, জাল মদের কারবার বন্ধে বহু বার পুলিশি নজরদারি বাড়ানোর দাবি করেছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy