তোর্সার বাঁধ মেরামত হয় না দীর্ঘ দিন। বাঁধ কেটে তৈরি হয়েছে নদীতে নামার সিঁড়ি। ছবি: হিমাংশুরঞ্জন দেব।
একদিকে বয়ে চলেছে তোর্সা। অন্যদিকে সমান্তরালভাবে এগিয়েছে শহর। নদী আর জনবসতির মাঝে অতন্দ্র প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশাল বাঁধ। কয়েক দশক আগে তোর্সার গ্রাস থেকে রাজার শহরকে বাঁচাতে তৈরি করা হয়েছিল ওই বাঁধ। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শহরের জনবসতি বাড়ায় রাজপথ থেকে পাড়ার অলিগলিতে বেড়েছে বহুতলের সংখ্যা। রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিন। শহরের সৌন্দর্যায়নে তৈরি হয়েছে ‘ঘড়িঘর’। দফায় দফায় নানাভাবে সাজিয়ে তোলা হয়েছে রাজবাড়ি, মদনমোহন বাড়ি, সাগরদিঘি, বৈরাগি দিঘি। কিন্তু ঠিক ততটাই অবহেলায় ক্রমশ বিপন্ন হয়ে পড়েছে শহরের রক্ষাকবচ তোর্সার বাঁধ। প্রদীপের নীচে অন্ধকারের মতই।
কোচবিহার শহর লাগোয়া হরিণ চওড়া থেকে টাকাগছ পর্যন্ত প্রায় ১০ কিমি এলাকা জুড়ে ওই বাঁধের বিস্তৃতি। বাঁধের গা ঘেষে রয়েছে গোটা কোচবিহার শহরের সীমানা। ১৩,১৪,১৫,১৬,১৮,১৯ সহ অন্তত সাতটি ওয়ার্ড একেবারে বাঁধ লাগোয়া। পরোক্ষভাবে ওই ওয়ার্ডগুলিতে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপের মাসুল গুনছে ওই বাঁধ। এমনকি সাধারণ সড়কের মত ওই বাঁধের ওপরেও চলছে অবাধে যান চলাচল।
স্বাভাবিক ভাবেই কাহিল অবস্থা শহরে রক্ষাকবচের। কোথাও মাটি ধসে পড়েছে। কোথাও বেরিয়ে রয়েছে পাথর। বাঁধ কেটে রীতিমতো ঢালাই করে তৈরি করা হয়েছে সিঁড়ি। কয়েকদিনের টানা বর্ষণে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু জায়গায় ছোটবড় গর্ত তৈরি হয়েছে। ঘন বসতির চাপ তো রয়েইছে। তার ওপর নদীর গতিপথ আগে বাঁধ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকলেও গত এক বছর ধরে চর ভেঙে কিছুটা বাঁধমুখী হয়েছে নদী।
এসব নিয়েই তৈরি হয়েছে বিপদের আশঙ্কা। শহরবাসীর অভিযোগ, দীর্ঘদিন বাঁধটির আমূল সংস্কার করা হয়নি। মাঝেমধ্যে বিক্ষিপ্ত কিছু মেরামতের কাজ করেই দায় সারছে সেচ দফতর। কোচবিহার হেরিটেজ সোসাইটির সম্পাদক অরূপজ্যোতি মজুমদার বলেন, “ ১৯৫৪ সালে তোর্সার ভয়াবহ বন্যায় শহরের কেশব আশ্রম, পাটাকুড়া, হাজরাপাড়ার বিস্তীর্ণ এলাকা নদীগর্ভে চলে যায়। শহরেও জল ঢুকেছিল। তারপরেই কোচবিহারের মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণের আমন্ত্রণে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু কোচবিহারে এসে ওই বাঁধ তৈরির উদ্যোগ নেন। কিন্তু বাঁধটির রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছেনা। জবরদখল থেকে মাটি কাটা সবই চলছে। ” কোচবিহার নাগরিক অধিকার সুরক্ষা মঞ্চের সভাপতি রাজু রায় বলেন, “জওহরলাল নেহেরু প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন কেন্দ্রের বরাদ্দে ওই বাঁধ তৈরি হয়েছিল। অথচ গত দুই দশকে ওই বাঁধের পূর্ণাঙ্গ সংস্কার হয়নি। বর্ষার আগে সেচ দফতর সামান্য মেরামত করে দায় এড়াচ্ছে। ফলে বিপদের আশঙ্কা থাকছেই।”
কোচবিহারের জেলাশাসক পি উল্গানাথন জানান, ইতিমধ্যে বাঁধ সংস্কারের ব্যাপারে সেচ দফতরের আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। জেলাশাসক বলেন, “বাঁধের বিপদজনক অংশ চিহ্নিত করে তা সংস্কার করার জন্য সেচ দফতরকে বলা হয়েছে। বাঁধ ঘিরে জবরদখলের বিষয়টিও আমাদের নজরে রয়েছে। বিষয়টি দেখা হচ্ছে।”
সেচ দফতর অবশ্য জানাচ্ছে, ওই বাঁধের রক্ষনাবেক্ষণের জন্য পৃথক একটি দল রয়েছে। ওই দলের কর্মীরা নিয়মিত বাঁধের হাল হকিকত নজরদারি করেন। জেলা সেচ দফতরের এক কর্তা বলেন, “বাঁধ নিয়ে শঙ্কার কিছু নেই। আমাদের তরফে সবসময় নজরদারি চালান হয়। প্রয়োজনমত আমরা সব ব্যবস্থা নেব।”
বাঁধ ভেঙে বন্যার জল না ঢুকলেও সামান্য ভারী বৃষ্টিতেই কোচবিহার শহর অবশ্য জল থইথই চেহারা নিচ্ছে। রাজার শহরের ওই হাল এবার গ্রীষ্মের বৃষ্টিতেই স্পষ্ট হয়েছে। কেন এমন দশা? তা নিয়েও ফুঁসছেন শহরবাসী।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy