প্রতীকী ছবি।
যে কাঠের কাজ করে, সে চাইলে রাঁধেও। যে রংমিস্ত্রি বা টোটো চালায়, সে-ও করে। নিজের জন্য নয় অবশ্য। যাঁরা বাড়ি ফিরছেন এতটা পথ পেরিয়ে, তাঁদের জন্য হাতা-খুন্তি নিয়ে নেমে পড়া সেই সব হাতের ঠেলায় তৈরি হচ্ছে ডিম-ভাত।
সেই খাবার নিয়ে তাঁরা দাঁড়িয়ে পড়ছেন জাতীয় সড়কের ধারে। কেন? সেখান দিয়ে হাজার হাজার মানুষ যাচ্ছেন তো! দীর্ঘদিন ধরে হেঁটে চলা সেই মানুষজনের পেটে হয়তো বেশ কয়েক দিন দানাপানি পড়েনি। সঙ্গে হয়তো বাচ্চা রয়েছে। খিদে-তেষ্টায় সে হয়তো ঝিমিয়ে পড়েছে। ‘‘তাদের হাতে একটু খাবার, একটু জল তুলে দিতে যে কী আনন্দ!’’ বলছিলেন ওই দলেরই এক যুবক।
কাদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে জলপাইগুড়ির এই যুবকদের?
দুই পা ফুলে গিয়েছে, রক্ত গড়াচ্ছে এক পথিকের। যুবকদের দেওয়া বোতল থেকে কয়েক ঢোক জল খেয়ে তিনি বলেছিলেন, “শেষমেশ বাড়ি যদি পৌঁছতেও পারি, হাঁটতে হাঁটতে পা পচে যাবে।” এক যুবক প্রশ্ন করেন, “দু’পায়ে দু’রঙের হাওয়াই চটি কেন?” তাঁর উত্তর, ‘‘হাজার হাজার মানুষ বাড়ির দিকে হাঁটছে। কে কখন কোথায় চটি ফেলে যায়! সেখান থেকেই কুড়িয়ে নিয়েছি, একটা কলকাতায়, আর একটা ইসলামপুরে।’’
কোথা থেকে আসছেন? “ভুবনেশ্বর। সেখানে কাঠের কাজ করতাম।” কথা শেষ হওয়ার আগেই যুবকের দলের একজন বলে ওঠেন, “আমিও তো কাঠের কাজ করি। এখন লকডাউনে বন্ধ।” আঙুল তুলে দেখাতে থাকেন যুবক, “ও রঙের কাজ করে, ও টোটো চালায়, ও লাইটের কাজ করে....।” কয়েকশো কিলোমিটার পথ হেঁটে আসা ওই পরিযায়ী শ্রমিকের সঙ্গে জাতীয় সড়কের ধারে এই ভাবেই পরিচয় হয়ে যায় তাঁদের। অসমের যোরহাটে ফিরতে থাকা শ্রমিকের কথা শুনে সে দিন থেকেই জলপাইগুড়ির বিবেকানন্দ পল্লির ওই যুবকরা পরিযায়ীদের খাওয়ানো শুরু করেন। তার পর থেকে দু’সপ্তাহ ধরে রোজ জাতীয় সড়কের ধারে ওঁদের ‘ক্যান্টিন’। প্রথম দিন ছিল খিচুড়ি, পরদিন থেকে ডিম-ভাত। দলের অন্যতম রানাপ্রতাপ সরকার বলেন, “আমরা সকলেই বাড়িতে রোজ একপদে নিরামিষ খাচ্ছি। সেখান থেকে বাঁচিয়ে হেঁটে ফেরা শ্রমিকদের ডিম-ভাতের খরচ জোগাড় হয়ে যাচ্ছে।”
লকডাউন শুরুর চার দিনের মাথায় জলপাইগুড়ির টিকিয়াপাড়ার দিন-আনি-দিন-খাই একদল বাসিন্দা ‘কমিউনিটি কিচেন’ শুরু করেছেন। প্রতি বেলা রান্না হচ্ছে পাড়ার সব গরিবের জন্য। পেশায় গাড়িচালক অমিত রায় বললেন, “সকলে মিলে একসঙ্গে ভাগ করেও যে খাওয়া যায়, লকডাউন না হলে টেরই পেতাম না!”
এমন অনেকে রয়েছেন চায়ের জেলার আনাচে কানাচে। জলপাইগুড়ি শহরের একদল যুবক লকডাউনের মধ্যে টানা এক সপ্তাহ ডুয়ার্সের একটি বাগানে গিয়ে শ্রমিকদের খাইয়েছেন। চা শ্রমিক এবং শহরের দুঃস্থদের জন্য রোজ রান্না করে চলেছে অসম মোড়ের একটি সংস্থা। ময়নাগুড়ির একটি ক্লাবের সম্পাদক দেবব্রত গোস্বামী জানালেন, তাঁরা আশেপাশের বিভিন্ন বনবস্তিতে গিয়ে খাওয়াচ্ছেন। শারীরিক ভাবে যাঁরা সক্ষম নন, তাঁদের চাল, আলু, আনাজের প্যাকেট পৌঁছে দিয়েছে জলপাইগুড়ির নেতাজি পাড়ার একটি ক্লাব।
জেলাশাসক অভিষেক তিওয়ারি বলেন, “বহু মানুষ আমার চেম্বারে এসে সাহায্যের চেক তুলে দিচ্ছেন। সে খবর তাঁরা কোথাও জানাচ্ছেন না, ছবিও তুলছেন না। এঁদের কুর্নিশ।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy