Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

রাত পেরোলেও কাটেনি বিপর্যয়ের রেশ

ঘুর্ণাবতের টানে বঙ্গোপসাগর থেকে তীব্র বেগে জলীয় বাস্প ভরা বাতাস ছুটে এসেছিল উত্তরবঙ্গে। তার জেরেই ঝড়-শিলাবৃষ্টিতে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল উত্তরের তিন জেলার স্বাভাবিক জনজীবন। শনিবার রাতের ঝড়-শিলাবৃষ্টির জেরে রবিবারও বিপর্যস্ত থাকল উত্তরবঙ্গ। রবিবার বিকেল পর্যন্ত লোডশেডিং চলেছে বিভিন্ন এলাকায়।

ঝড়ের রেশ রয়েছে রবিবারেও। শিলিগুড়িতে বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।

ঝড়ের রেশ রয়েছে রবিবারেও। শিলিগুড়িতে বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:০০
Share: Save:

ঘুর্ণাবতের টানে বঙ্গোপসাগর থেকে তীব্র বেগে জলীয় বাস্প ভরা বাতাস ছুটে এসেছিল উত্তরবঙ্গে। তার জেরেই ঝড়-শিলাবৃষ্টিতে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল উত্তরের তিন জেলার স্বাভাবিক জনজীবন। শনিবার রাতের ঝড়-শিলাবৃষ্টির জেরে রবিবারও বিপর্যস্ত থাকল উত্তরবঙ্গ। রবিবার বিকেল পর্যন্ত লোডশেডিং চলেছে বিভিন্ন এলাকায়। সমতলের সঙ্গে একই রকম ক্ষতি হয়েছে পাহাড়েও। গাছ পড়ে দার্জিলিঙে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। অন্য দিকে, ঝড়ে হেলে যাওয়া বাড়ির ছাদে থাকা হোর্ডিং সরাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়েছে এক ব্যক্তির।

শনিবার রাত ৮টার পর থেকে কয়েক দফায় বজ্রপাত সহ ঝড় বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত হয় জলপাইগুড়ি জেলার ধূপগুড়ি, ময়নাগুড়ি, লাটাগুড়ি, নাগরাকাটা সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় জনজীবন। ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত গ্রীষ্মকালীন সবজি। কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, শুধুমাত্র ধূপগুড়ি ব্লকের ১২টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় প্রায় ৬ কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়েছে। জেলা কৃষি আধিকারিক সুজিত পাল জানিয়েছেন, ময়নাগুড়ি ব্লকের চারটি গ্রাম পঞ্চায়েত এবং নাগরাকাটার দুটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকাতেও ভাল ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিক হিসেবে জেলায় ফসল ক্ষতির পরিমাণ ১০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। ঝড়ে বিপর্যস্ত গরুমারা এবং নেওরাভ্যালি জঙ্গলের বিস্তীর্ণ এলাকা। বন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, হাজারের বেশি বড় গাছ উপড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। ওই কারণে রবিবার জঙ্গল ভ্রমণ বন্ধ রাখা হয়েছে। রেঞ্জ অফিস এবং বন কর্মীদের কোয়ার্টারের চাল উড়ে গিয়েছে। গরুমারা জঙ্গলের রামসাই, টুণ্ডু এলাকায় প্রচুর গাছ উপড়ে পড়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়েছে। রেঞ্জ অফিসের চাল উড়ে গিয়েছে।

জলপাইগুড়ির জেলাশাসক পৃথা সরকার বলেন, “শনিবার রাতের ঝড়ে ধূপগুড়ি, ময়নাগুড়ি, লাটাগুড়ি, নাগরাকাটা সহ বেশ কিছু এলাকায় ক্ষতি হয়েছে। ঘরবাড়ি নষ্ট হয়েছে। প্রচুর গাছ ভেঙে পড়েছে। ক্ষয়ক্ষতির হিসেব চলছে। ত্রাণের সমস্যা নেই। ব্লক প্রশাসনের কর্তাদের যুদ্ধকালীন তৎপরতার সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।”

জলপাইগুড়ি জেলা জুড়ে ঝড়ে গাছের ডাল ভেঙে জখম হয়েছেন অন্তত ৭০ জন। তাঁদের বিভিন্ন হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। প্রাথমিক হিসেবে জেলায় প্রায় ২০ হাজার মানুষ ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্তত দেড় হাজার বাড়ির চাল উড়ে গিয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ধূপগুড়ি ব্লক। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, এখানে প্রায় ১৬ হাজার মানুষ বিপন্ন হয়েছেন। বিন্নাগুড়ি, সাকোয়াঝোরা-১, বানারহাট-১, বানারহাট-২, গধেয়াকুঠি, গাদং-১, গাদং-২, মাগুরমারি-১, ঝারআলতা-১, ঝারআলতা-২, শালবাড়ি-২ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় এক হাজারের বেশি বাড়ির চাল উড়ে গিয়েছে।

ধূপগুড়ি হাসপাতাল কোয়ার্টারের চাল উড়ে গিয়েছে। ময়নাগুড়ি ব্লকের রামসাই এলাকায় অন্তত দুশো বাড়ির চাল উড়ে গিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে চা বাগান। জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের পানপাড়া, তোরল পাড়া এলাকায় গাছ উপড়ে শতাধিক বাড়ি নষ্ট হয়েছে। মেহেরুন্নেসা হাই স্কুলের চাল উড়ে গিয়েছে। এদিন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরে দেখেন ধূপগুড়ির সিপিএম বিধায়ক মমতা রায়, পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূল সভাপতি দীপিকা ওঁরাও সহ বিভিন্ন দলের নেতারা। ময়নাগুড়িতে রামসাই এলাকায় যান স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূল সভাপতি সুভাষ বসু।

জলপাইগু়ড়িতে সন্দীপ পালের তোলা ছবি।

রবিবার বিকেলেও বিস্তীর্ণ এলাকায় বিদ্যুৎ পরিষেবা স্বাভাবিক করা সম্ভব হয়নি। সাকোয়াঝোরা এলাকায় বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে তার ছিঁড়ে দূরে ছিটকে পড়েছে। বিপর্যস্ত হয়েছে টেলিফোন ও মোবাইল ফোন পরিষেবা। জলপাইগুড়ির মহকুমাশাসক সীমা হালদার জানান, যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পরিষেবা স্বাভাবিক করার কাজ চলছে।

শনিবার রাতের ২০ মিনিটের ঝড় বৃষ্টিতে নূরপুর ৪০ কাঁচা বাড়ি ভেঙে পড়েছে। এছাড়া ওই গ্রামের একটি গির্জা ঘরের চাল উড়ে গেছে। রায়ডাক চা বাগানে ৩৫ শ্রমিক আবাস ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ওই দুটি এলাকার অন্তত ২০০ সুপারি গাছ ভেঙে পড়ে।

ঝড়ে প্রায় তিনশো বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কালচিনি ব্লকের জয়গাঁ এলাকায়। জয়গাঁ গুয়াবাড়ি এলাকায় কোথাও গাছ ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ছে বাড়ি কোথাও আবার ঝোড়ো হাওয়া ঘরের টিনের চাল উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে। ঝড়ের দাপটে এখনও বিদ্যুৎহীন হয়ে রয়েছে বিভিন্ন এলাকা। রাজ্য বিদুৎবণ্টন বিভাগের আলিপুরদুয়ারের বিভাগীয় বাস্তুকার দীপঙ্কর দাস বলেন, “ কিছু জায়গায় কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া যাবে না।”

ঝড়ে তছনছ হয়ে যায় গুয়াবাড়ির বেশ কিছু ঘরবাড়ি। জয়গাঁর ভুলনটারি মোড়ের কাছে রাস্তার উপর পড়ে যায় বড় বড় গাছ। তোর্সা চা বাগানের বেশ কিছু ছায়া গাছ ভেঙে চা গাছের উপর পড়ে। রবিবার সকালে এলাকায় যান কালচিনির বিধায়ক তথা জয়গাঁ উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান উইলসন চম্প্রামারি। তিনি বলেন, “এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বহু ঘরে ভেঙে গিয়েছে। ত্রাণের জন্য প্রশাসনকে বলা হয়েছে।’’

জয়গাঁ গোপীমোহন ময়দানে চলছে গোর্খা আদিবাসী উৎসব। রবিবার ছিল শেষ দিন। শনিবার রাতে মঞ্চ থেকে মেলার দোকান পাট ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। সংগঠনের তরফে গোপাল বাহাদুর সুয়েল বলেন, “মঞ্চটি ফের বানানো হয়েছে। রাতে সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আছে। তাতে মোর্চা সুপ্রিমো বিমল গুরুঙ্গ উপস্থিত থাকবেন।”

ফালাকাটা ব্লকের গুয়াবরনগর গ্রাম পঞ্চায়েত মালসাগাঁওতে ঝড়ে ৫০টি ঘর ভেঙে গিয়েছে। জলদাপাড়া বনাঞ্চলের ১৩০ টি গাছ ভেঙে পড়ে। গাছ ভেঙে পড়ায় চারটি কর্মী আবাসন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বনের পথে গাছ ভেঙে পড়ায় গাড়ি চলাচলে অসুবিধা হলেও রবিবার সকলে গাছ সরিয়ে জিপ সাফারি চালু করা হয়।

ঝড়ে দার্জিলিঙের অন্তত ২৪০টি বাড়ি পুরোপিরি ভেঙে গিয়েছে বলে প্রশাসন জানিয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ১২০০ বাড়ি। কালিম্পঙের বাসিন্দা রামবাহাদুর ভূজেলের (২৭) গাছ পড়ে মৃত্যু হয়েছে। জিমখানা রিসর্টের সামনে গাছ পড়ে অন্তত ৮টি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। আর্য চা বাগান সহ রিশিয়াত, লেবং, সিঙমারি, বিজনবাড়ি এলাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে। কালিম্পঙের দালাপচাঁদ, ছেনুবস্তি ছাড়াও কার্শিয়াঙেও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

জিমখানা ক্লাবের সামনে ক্ষতিগ্রস্ত এক গাড়ির চালক মিথিলেশ শর্মা বলেন, ‘‘খুব জোর বেঁচে গিয়েছি। ঝড় শুরু হওয়ার পরেই গাড়ি থেকে বের হই। সঙ্গে সঙ্গে একটা বড় ডাল পড়ে গাড়ির সামনের অংশ ভেঙে যায়। গাড়িতে থাকলে মারা পরতাম।’’

বিদ্যুৎ দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে, দার্জিলিঙে অন্তত ২০০টি লাইটপোস্ট উপড়ে পড়েছে। জিটিএ-এর সভাসদ বিনয় তামাঙ্গ বলেন, ‘‘জিটিএ-র চিফের নির্দেশে সর্বত্র ক্ষয়ক্ষতির সমীক্ষা এবং ত্রাণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’’

পাহাড় এবং সমতলের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলিতে দ্রুত ত্রাণ পৌঁছতে প্রশাসনকে অনুরোধ জানিয়েছেন বলে দার্জিলিঙের বিজেপি সাংসদ সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া জানিয়েছেন।

ঝড়ে গাছ উপরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিপর্যস্ত হওয়ায়, শিলিগুড়ি শহরের বেশ কিছু এলাকায় রবিবার সকাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ ছিল না। শহরের দেবাশিস কলোনি এলাকায় এ দিন সকালে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে মৃতের নাম তপন দাস (৫১)। তাঁর বাড়ির ছাদে একটি রাজনৈতিক দলের ভোট প্রচারের হোর্ডিং ছিল। ঝড়ে সেটি হেলে পড়ায় তপনবাবু সোজা করতে ছাদে উঠেছিলেন বলে পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে। সে সময়েই পাশ দিয়ে যাওয়া তারে তিনি বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়ে ছাদ থেকে পড়ে যান বলে জানা গিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE