Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

কাছের মানুষদের হারিয়ে হাহাকার পরের পর বাগানে

দক্ষিণ ভারতে কাজের সন্ধানে গিয়ে এক মাত্র ছেলে নিখোঁজ হয়েছেন। সে প্রায় তিন বছর আগের কথা। এখনও ছেলে ফেরার আশায় উঠোনে বসে অপেক্ষা করেন বৃদ্ধা মুন্দরি কিসান। ছেলের খোঁজে বহু ঘুরে ব্যর্থ হয়েছেন চা বাগানের অবসর প্রাপ্ত শ্রমিক হরি। হারানো ছেলের শূন্যতা কিছুটা হলেও ভরাট করেছিল দুই নাতনি ও এক নাতি। চা বাগানে কাজ করে সংসার চালাতেন পুত্রবধূ ফুলমণি।

মাদারিহাটে দুর্ঘটনায় মৃত কনের বোন ও ঠাকুরমা। ছবি: রাজকুমার মোদক।

মাদারিহাটে দুর্ঘটনায় মৃত কনের বোন ও ঠাকুরমা। ছবি: রাজকুমার মোদক।

নিলয় দাস
আলিপুরদুয়ার শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৫ ০১:৩০
Share: Save:

দক্ষিণ ভারতে কাজের সন্ধানে গিয়ে এক মাত্র ছেলে নিখোঁজ হয়েছেন। সে প্রায় তিন বছর আগের কথা। এখনও ছেলে ফেরার আশায় উঠোনে বসে অপেক্ষা করেন বৃদ্ধা মুন্দরি কিসান। ছেলের খোঁজে বহু ঘুরে ব্যর্থ হয়েছেন চা বাগানের অবসর প্রাপ্ত শ্রমিক হরি। হারানো ছেলের শূন্যতা কিছুটা হলেও ভরাট করেছিল দুই নাতনি ও এক নাতি। চা বাগানে কাজ করে সংসার চালাতেন পুত্রবধূ ফুলমণি। মজুরির টাকা জমিয়েই বড় মেয়ে মণির বিয়ে দেন ফুলমনি। কিন্তু বৌভাতের রাত ফুরোতেই সব শেষ।

শুক্রবার ভোরে মেয়ে ও জামাইকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় মাদারিহাটের কাছে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ফুলমনি তার মেয়ে মণি ও জামাই আকাশের । মুন্দরিও হরির এক মাত্র নাতি জগদীশ উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। তিন বছরের মধ্যে দুটি শোকের ধাক্কায় স্থবির চুয়াপাড়ার এগারো নম্বর লাইনের শ্রমিক বস্তির ওই বাড়ি। এখন জীবিত বলতে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এবং তাঁদের বছর আটেকের এক নাতনি।

গত মঙ্গলবার বাড়িতে বড় নাতনি মণির বিয়ের আসর বসে। প্যান্ডেল করা হয়। এখনও বাড়ির উঠোনে সেই প্যান্ডেলের কাঠামো। এখানে বসেই বৃদ্ধা মুন্দরি বলে উঠলেন, ‘‘ন’ দিন বাদে এই বিয়ের আসরে মা ও মেয়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হবে। ঈশ্বরের কাছে শুধু প্রার্থনা করছি নাতিটা যেন ভাল হয়, ও সুস্থ হয়ে ফিরুক।’’ কয়েকটি কথা বলার পর উদাস হয়ে যাচ্ছেন বৃদ্ধা। হরিবাবু দিশা হারা হয়ে বাগানে ঘুরছেন। বাগানের বাসিন্দাদের কাছে সান্ত্বনা দেওয়ারও ভাষা নেই। শুক্রবার সন্ধ্যায় বাগানে ছ’জনের নিথর দেহ এসে পৌঁছনোর পর চুয়াপাড়া বাগান জুড়ে কান্নার রোল পড়ে যায়। পানা নদীর পাড়ে শ্মশান ঘাটে পর পর দাহ করা হয় চারটি দেহ।

বাগানের বারো নম্বর লাইনে এক পরিবারের সদস্য শ্বশুর জুলিয়া কিসান (৬৫) ও পুত্রবধূ সোমারি (৩৫) কিসানের দেহ শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত রেখে দেওয়া হয়। সোমারির স্বামী মহেশ উত্তরপ্রদেশে এক কারখানার শ্রমিক। বাবা ও স্ত্রীর মৃত্যু সংবাদ পাবার পর তার বাগানে পৌঁছতে শনিবার সন্ধ্যা হয়ে যায়। ওই দু’টি দেহ শনিবার দিনভর পড়েছিল বাড়ির উঠোনে। চুয়াপাড়া বাগানের পঞ্চায়েত সদস্যা প্রতিমা ওঁরাও-এর কথায়, ‘‘শুক্রবার বাগানের তিনটি লাইনের প্রায় কোনও বাড়িতেই উনুন জ্বলেনি। রাত ভর কান্নার শব্দ ভেসে এসেছে ঘর গুলি থেকে। সান্ত্বনা দেবার মত ভাষা নেই আমাদের কারও।’’

এদিকে, রাতে আলিপুরদুয়ার ১ নম্বর ব্লকের মথুরা চা বাগানে চার কিশোরীর দেহ পৌঁছনোর পর তাদের দেহ সনাক্ত করেন পরিবারের লোকজনেরা। মৃতরা হলেন, সুজিতা ওঁরাও (১৮) ও রসিতা ওঁরাও (১৬ )। তারা সম্পর্কে দুই বোন। অন্য দুই কিশোরীর নাম তারা মুন্ডা (১৭)ও জুলিতা লাকড়া (১৮)। রাতে ওই বাগানেও কান্নার রোল। দুই মেয়েকে হারিয়ে দিশাহারা চা শ্রমিক বিরসা ওঁরাও। তাঁর কথায়, ‘‘মাসির মেয়ের বিয়েতে দুই বোন মঙ্গলবার চুয়াপাড়া যায়। এখন তাদের দেহ বাড়ি ফিরল।’’ শোকতপ্ত চা শ্রমিক ও বাসিন্দারা শনিবার বিকালে মোমবাতি হাতে নিয়ে বাগানে শোক মিছিল বের করে। বাগানের তৃণমূল নেতা সুব্রত সরকারের কথায়, ‘‘এই ধরণের ঘটনা মানতে পারছিনা কোনও ভাবে। চার কিশোরীর মৃত্যুতে আমরা সকলে শোকাহত।’’

শুক্রবার সন্ধ্যায় বানারহাট থানার মরাঘাট চা বাগানে নব দম্পতি সহ অপর যুবক নাইমার ওঁরাও এর দেহ আনা হয়। কান্নায় ভেঙে পড়েন বাসিন্দারা। রাঙাতি নদীর তীরে দাহ করা হয়। আকাশ মঙ্গরের বাড়িতে সে ছাড়া আর কেউ নেই। ঘরের বাইরে উঠোনে সামিয়ানা টাঙানো রয়েছে। ঘরের বাইরে কয়েকটি বাসন ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তার বাড়ি থেকে কিছু দূরে বন্ধু নাইমারের বাড়ি। এক মাত্র ছেলে কে হারিয়ে কান্না থামছে না মা পান্তি ওঁরাও-এর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE