Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
আঁধারে বাগান/২

অভাবের দিন বদলায় না রহিমাবাদে

সদ্য শেষ হল চা বাগানে তিন দিনের ধর্মঘট। শ্রমিকদের দাবি ছিল ন্যূনতম মজুরির। উত্তরের কিছু বাগানে কী অবস্থায় আছেন শ্রমিকেরা, খোঁজ নিল আনন্দবাজার।ফেলিসিতা হাটা দেয় তাঁর পিছন পিছন হাঁটতে থাকে গীতা শা, লক্ষ্মী চিকবরাইকরা। তাঁরা শামুকতলার রহিমাবাদ চা বাগানের খোয়ার লাইনের বাসিন্দা তাঁরা। কেমন ওই চা বাগান? বাসিন্দারা জানান, বছর তিনেক আগে বাগান বন্ধ ছিল। সেই সময় কষ্ট তাঁদের চরমে পৌঁছয়। পেটের টানে পাহাড়ি নদীর ধারে পাথর তোলার কাজ শুরু করে অনেকে। কেউ কেউ চলে যায় ভিন্‌ রাজ্যে। তার পর অনেকে ফিরে আসেনি।

নমিতেশ ঘোষ
কোচবিহার শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০১৮ ০৮:০০
Share: Save:

পাশ দিয়ে কুলুকুলু শব্দে বয়ে চলেছে পাহাড়ি নদী। খানিক দূরেই হাতছানি দিয়ে ডাকছে জয়ন্তী পাহাড়। চারদিকে সবুজের সমারোহ।

কার্তিক জঙ্গলে এই অপরূপ সৌন্দর্যের মধ্যে ফি বছর পর্যটকদের ঢল নামে। তবে প্রকৃতির কোলে যাঁদের সম্বৎর বাস, সেই ফেলিসিতা লাকড়াদের জীবন বদলায় না। সকাল হলেই চা বাগানে ছোটে ওঁরা। তারপর দুপুর গড়িয়ে বিকেল পড়তেই দল বেঁধে চলতে থাকে সেই জঙ্গলে। সেখানে ‘শাক’ পাওয়া যায়। তাঁদের ভাষায় ‘বেন্দলা রং’। গাছে ঝুলে থাকে ‘সজনা ডাঁটা’। সে সব সংগ্রহ করে ঘরে ফেরে ওঁরা। তা সেদ্ধ করে। কেউ একটু নুন তেল দিয়ে আনাজ তৈরি করে। তাই দিয়ে চলে তিন বেলার খাওয়া-দাওয়া।

শীর্ণকায় শরীরের অপুষ্টির ছাপ স্পষ্ট। পরনে সেই বহুদিনের পুরনো শাড়ি। হাতে ব্যাগ। হাসি হাসি মুখে ফেলিসিতা বলেন, “কী করব বাবু। চোদ্দ দিন পর পর হাজিরার টাকা পাই। একসঙ্গে পেলেও তা দিয়ে তো আর সংসার চলে না। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করাতে হয়। তার পর তো খাওয়া।” ফেলিসিতা হাটা দেয় তাঁর পিছন পিছন হাঁটতে থাকে গীতা শা, লক্ষ্মী চিকবরাইকরা। তাঁরা শামুকতলার রহিমাবাদ চা বাগানের খোয়ার লাইনের বাসিন্দা তাঁরা। কেমন ওই চা বাগান? বাসিন্দারা জানান, বছর তিনেক আগে বাগান বন্ধ ছিল। সেই সময় কষ্ট তাঁদের চরমে পৌঁছয়। পেটের টানে পাহাড়ি নদীর ধারে পাথর তোলার কাজ শুরু করে অনেকে। কেউ কেউ চলে যায় ভিন্‌ রাজ্যে। তার পর অনেকে ফিরে আসেনি।

বাগান এখন খুলে গিয়েছে। প্রতিদিন কাজও হচ্ছে বাগানে। তার পরেও জীবনযাত্রায় বড় কোনও পরিবর্তন নেই। কিসনু চিক বরাইক, দীনেশ ওঁরাওরা জানান, একদিন কাজ করলে ১৫০ টাকা করে হাজিরা পাওয়া যায়। দু’সপ্তাহ পরে সেই টাকা একখানে করে দেওয়া হয় তাঁদের। সেই টাকাতেই খাওয়া, বাড়ির কাজকর্ম সব করতে হয়। বাড়ি বলতে কারও টিনের ছাউনি রয়েছে। কেউ খড় দিয়ে ছাউনি দিয়ে প্লাস্টিকে ঢেকে রেখেছেন। সেই ঘরেই রান্না, খাওয়া, থাকা। অনেকের বাড়িতেই নেই শৌচাগার। সকাল হওয়ার আগেই তাঁদের ছুটতে হয় নদীর ধারে। গোটা গ্রামে তিনটি গভীর নলকূপ। সেখান পানীয় জল সংগ্রহ করতে হয় সবাইকে। সব মিলিয়ে একটি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। কিসনু বলেন, “খুব কষ্ট করে চলি। শৌচাগার তৈরির মতো টাকা আমাদের নেই।”

বাগানে অসুস্থ মানুষের সারি। পেটের রোগ থেকে জ্বর, সর্দি লেগেই আছে। বাগানে অবশ্য একটি হাসপাতাল আছে। সেখান থেকে ছোটখাটো ওষুধ মেলে। একটা ভারী রোগ হলে অবশ্য তাঁদের ছুটতে হয় কুড়ি কিলোমিটার দূরের আলিপুরদুয়ার জেলা হাসপাতালে। একটি প্রাথমিক ও হাইস্কুল অবশ্য রয়েছে। সেখানে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা যায়। ওই বাগানের ৯৩ বছরের বৃদ্ধ ফসকু বরাইক বলেন, “আমরা তো এভাবেই বেঁচে আছি বহু যুগ ধরে। অনেকের চলে যাওয়া দেখেছি। আমি আছি। জানি না এভাবে আরও কতদিন থাকব।”

রহিমাবাদের পাশেই জয়ন্তী, কার্তিক, থেকে দূরের মধু সর্বত্র যেন একই চিত্র।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Economics Tea Garden Poor
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE