শ্রমের বদলে টাকায় নয়, মজুরি আদানপ্রদান হচ্ছে উৎপাদিত দ্রব্যে। ধান কাটার মজুরি হিসেবে ধানই মিলছে দক্ষিণ দিনাজপুরের তপন ব্লকের খেত মজুরদের। এক বিঘে জমির ধান কাটার বদলে তারা পাচ্ছে ৪ মণ ধান।
তবে জমির ধান কেটে দিলেই শুধু হবে না। চুক্তি অনুযায়ী ধান কেটে জমি থেকে মালিকের ঘরের চৌকাঠ অবধি নিয়ে যেতে হবে। ঝাড়াই-বাছাই করে গোলায় তুলে দেওয়া এবং খড়ের পালা গুছিয়ে দেওয়ার শর্তে ওই ধান-মজুরি মিলছে ভূমিহীন খেত মজুরদের। নগদের এই আকালের জেরে জমির মালিকদের চাপানো এই আদিম বিনিময় প্রথার শর্তেই ধান কাটতে হচ্ছে গরিব খেত মজুরদের।
তাতে পারিশ্রমিকের সঠিক মূল্যায়ণ হচ্ছে কিনা, তা ভেবে দেখার উপায় নেই বলে জানালেন তপনের পূর্ব নীমপুর এলাকার ভূমিহীন খেত মজুর চম্পা ওঁরাও। মঙ্গলবার এলাকার এক মালিকের ৬ বিঘা জমির ধান কেটে ঘরে তুলে দেওয়ার শর্তে স্ত্রী সুকুরমণি এবং মেয়ে দীপাকে নিয়ে হাতে কাস্তে ধরেছেন। চম্পা বলেন, ‘‘আমাদের দিন আনা দিন খাওয়া অবস্থা। পুরনো ৫০০ এবং হাজারের নোট আমাদের কাছে নেই।’’ ফলে নোট বাতিলের সঙ্গে তাঁদের সরাসরি সম্পর্কও থাকার কথা নয়। কিন্তু দিনমজুরির টাকা তো নগদে মিলছে না? ওই খেত মজুরের কথায়, ‘‘সংসার অচল হয়ে পড়েছে। নগদ টাকার অভাবে হাটবাজার বন্ধ। ভাতের সঙ্গে সব্জি জোটানো মুশকিল হয়ে পড়েছে। তাই বেঁচে থাকতে ওই ধান মজুরি-ই সই।’’
এ দিন দুপুরে ধান কেটে জমিতে স্ত্রী মেয়েকে নিয়ে জিরোচ্ছিলেন চম্পা। বড় মেয়ে দীপা বালাপুর হাইস্কুলে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী। অভাবের টানে স্কুল বাদ দিয়ে বাবা মায়ের সঙ্গে ধান কাটায় সে-ও হাত লাগিয়েছে। সুকুরমণিদেবী বলেন, ‘‘তিন ছেলেমেয়ে সকলে স্কুলে পড়ে। বড় মেয়ে আর নবম শ্রেণির পড়ুয়া মেজ মেয়ের গৃহশিক্ষকের টিউশনের খরচ মাসে ৬০০টাকা এখনও দিতে পারিনি। জমি জিরেত কিছু নেই। দিনমজুরির উপর ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা হয়।’’
সুকুরমণিদেবীদের ৬ বিঘে জমির ধান কেটে মালিকের ঘরে তুলতে অন্তত ৬ দিন লাগবে। তাতে কী? ইতিমধ্যে বেশ কিছু এলাকায় জমির মালিকেরা বিঘে প্রতি ধান কাটা ও ধান ঝাড়াই করা গাড়ি ১০০০ টাকায় ভাড়া করে নিমেষে জমির ধান কেটে নিচ্ছেন। সেই তুলনায় খেত মজুরদের বিঘে প্রতি ৪ মণ ধান মজুরি দিয়ে তাঁদের লোকসান করা হচ্ছে না বলে জমির মালিকদের দাবি। কেন না ধানের দাম রোজ কমছে। গত এক সপ্তাহে মণ প্রতি ৩০০ টাকা থেকে ধানের দাম ২৪০ টাকায় নেমে গিয়েছে। তপনের ওই মালঞ্চা অঞ্চল থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে বালুরঘাটের জলঘর অঞ্চলে আবার মজুরি বেড়ে পাঁচ মণ।
ধান কেটে মজুরির ধানের উপর ভরসা করে চম্পা, সুকুরমণিদের মতো ভূমিহীন খেত মজুর বিজয় পাহান, নিখিল বর্মন, সাঞ্চু ওঁরাওয়েরা ওই বিনিময় প্রথাই মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। বিজয়বাবুর বক্তব্য, ‘‘জবকার্ডে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে। ১০০ দিনের কাজ নেই। ফলে টাকাও নেই। এই মরসুমে ধান কেটে রোজগারের মজুরিতে সংসার চলে। টাকার বদলে মজুরির ধান নিয়ে ঠকছি কিনা, অত ভাবলে কি আমাদের চলবে?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy