Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

মেয়ে ফিরবে না, হাত টানে নাছোড় স্মৃতি

আশ্বিনের রোদ মাথায় ধূপগুড়ির মধ্যপাড়ার জমির আলে গাঁড়িয়ে ধান গাছের হাওয়ায় দোল খাওয়া দেখেন পঞ্চাশ পেরোনো এক কৃষক। দেখেন একের পর এক ট্রেনের চলে যাওয়া।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

অনির্বাণ রায়
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০২:১১
Share: Save:

হুশ করে চলে যায় ট্রেন। হাওয়ায় নুয়ে পড়া হওয়া ধানগাছগুলো আবার সোজা হয়ে দাঁড়ায়। দেড় বিঘা জমি জুড়ে সবুজ ধান। জমিতে জল আছে, এখন আর কিছু করার নেই। মাস পড়লে ধান কাটা হবে।

আশ্বিনের রোদ মাথায় ধূপগুড়ির মধ্যপাড়ার জমির আলে গাঁড়িয়ে ধান গাছের হাওয়ায় দোল খাওয়া দেখেন পঞ্চাশ পেরোনো এক কৃষক। দেখেন একের পর এক ট্রেনের চলে যাওয়া। তাঁর চশমা আটকানো লোহার তার পেঁচিয়ে। দিনভর আলের পাশে দাঁড়িয়ে শ্বশুরবাড়িতে ফিরে যান। বাড়ির চারপাশে কাশফুল ছেয়ে গিয়েছে। শহর আলোয় মোড়া। কোন মণ্ডপে কেমন ঠাকুর হয়েছে তা নিয়ে নানা গল্প শোনায় তাঁর ছোট দুই ছেলে-মেয়ে। তিনি ধৈর্য্য ধরে শোনেন। সন্ধ্যা নামে। ছোট দু’জনকে পাঠিয়ে দেন মণ্ডপে। বাল্বের লাইট নিভিয়ে দিয়ে চেয়ার টেনে স্বামী-স্ত্রী দু’জনে বসে থাকেন উঠোনে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গড়িয়ে যায়। আর একটা পুজো কেটে যায়।

‘‘পুজোর সময় বড় মেয়েটা বড্ড জ্বালাতন করত জানেন। এক দণ্ড বাড়িতে থাকতে দিত না। সন্ধে হলেই টেনে নিয়ে যেত বাইরে। আমি নতুন জামা না পরলে খুব জেদ করত,’’ বলেন তিনি। রোদে পুড়ে গায়ের রং প্রতিদিন যেন একটু করে কালো হয়ে যাচ্ছে। চামড়া কুঁচকে যাচ্ছে। বলতে থাকেন, ‘‘মেয়েটা আমার খুব জেদি ছিল। না হলে ভরা সালিশি সভায় মাতব্বরদের নির্দেশ কেউ অমান্য করতে পারে?’’ সেই বড় মেয়ের স্মৃতি এখনও পুজোর দিনে বাবাকে ‘জ্বালাতন’ করে। ছোট ছেলে-মেয়ে দু’জনকে নিয়ে একবার মণ্ডপে গিয়েছিলেন। বললেন, ‘‘হঠাৎ মনে হল জানেন, বড় মেয়েটা ডান হাত টেনে ধরেছে। বলছে দেখো বাবা, দেবীর গলায় পুঁতির মালা।’’ তিন বছর আগের কথা। ২০১৪ সাল। সে বার পুজোয় মেয়েকে পুঁতির মালা কিনে দেবেন ভেবেছিলেন।

সে বছরও ধান দিব্যি হয়েছিল। সেপ্টেম্বর মাস ছিল। শরৎকাল। মাসখানেক পরেই পুজো। রাতের বেলায় সালিশি সভায় বাবাকে মারধরের প্রতিবাদ করেছিল নবম শ্রেণির ছাত্রীটি। মাতব্বরেরা মেয়েটাকে থুতু চাটার হুমকি দিয়েছিল। প্রতিবাদী মেয়েটি শোনেনি। চুলের মুঠি ধরে মারধর করেও থুতু চাটাতে রাজিও করানো যায়নি। হাত ছেড়ে দৌড়ে পালিয়েছিল অন্ধকারে। পরদিন ভোরে রেল লাইনের পাশ থেকে বিবস্ত্র ছিন্নভিন্ন দেহ উদ্ধার হয় মেয়েটির।

মেয়েকে ধর্ষণ করে রেল লাইনের তলায় ছুড়ে ফেলে ‘খুনে’র অভিযোগ দায়ের করেছিলেন বাবা। টাকার প্রলোভন, হুমকি, এমনকী পাল্টা মামলায় ফাঁসিয়ে জেলেও পাঠানো হয়। তাতেও হাল ছাড়েননি বাবা। বাড়ি ছাড়া হতে হয়েছে। শ্বশুরবাড়ির গোয়ালঘর মেরামত করে সেখানেই রয়েছেন তিন বছর ধরে। জানালেন, এখনও কয়েকজন ‘রফা’ করে মামলা তুলে নিতে বলছেন। তিনি রাজি হননি। মেয়ের জেদই যেন পেয়েছে বাবাকে। বলছেন, ‘‘সুবিচার চাই। দোষীদের শাস্তি দেখব।’’

বছর বছর শরৎ আসে। রেল লাইনের পাশে মাথা দোলায় কাশের বন। সন্ধ্যা নামে ধূপগুড়িতে। আরতি শুরু হয় মণ্ডপে, বেজে ওঠে ঢাক, কাঁসর-ঘণ্টা। তখনই ম্লান বাল্বের আলো নিভে যায় মণ্ডপের পাশের এক উঠোনে। অন্ধকারে চেয়ার টেনে নিয়ে বসেন বাবা-মা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE