আরাধ্যা: সেবকেশ্বরী কালীমন্দিরে মঙ্গলবার। ছবি: স্বরূপ সরকার
গোটা পাহাড় ঘুমিয়ে পড়লেও ‘সেবকেশ্বরী মা’ জেগে থাকেন বলে ভক্তদের দৃঢ় বিশ্বাস। তাই অমাবস্যার রাতে পাহাড়ি পথে বিপদসঙ্কুল চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে পাহাড়চূড়ায় মন্দিরে হাজির হন। মঙ্গলবার কালীপুজোর রাতেও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১ হাজার ফুট উঁচু মন্দিরে সেই উপচে পড়া ভিড়। তিলধারণের জায়গা নেই। যে সেবক পাহাড় সূর্য ডুবলেই ঘুমিয়ে পড়ে, সেখানেই রাতভর ভক্তদের ভিড়। মন্দিরের তিন পুরোহিত স্বপন ভাদুড়ি, নন্দকিশোর গোস্বামী, লক্ষ্মণ ভাদুড়ি। তাঁদের মন্ত্রোচ্চারণে চারদিক গমগম করে।
ঠিক রাত ১০.৩৩ মিনিটে পুজো শুরু হয় সেবকেশ্বরী কালীমন্দিরে। জাতীয় সড়কে চটিজুতো রেখে সিঁড়িতে পা দিতে হয়। তা রাখার জায়গা নেই। মানতের পাঁঠার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মন্দিরের উপরে পাহাড়ের কোলে সারি সারি খিচুড়ির কড়াই। সন্ধ্যা থেকে ৪০ কড়াই নেমেছে। আরও হতেই থাকবে। কমিটির সম্পাদক অর্চিস্মান ঘটক বললেন, " ভোর অবধি চলবে ভোগের খিচুড়ির আয়োজন। মায়ের টানে পাহাড়-সমতল একাকার এখানে। জাগ্রত মা। তাই জেগে থাকতে হয় সন্তানদেরও।"
মন্দিরের চাতালের একদিকে কালীঝোরার দীনেশ সুব্বা, মংপংয়ের সরিতা রাই, শিলিগুড়ির এষা সরকাররা পাশাপাশি বসে অঞ্জলি দিচ্ছেন। মন্দির কমিটির বর্তমান সভাপতি স্বপন বসু বলেন, ‘‘পাহাড়-সমতলের মিলনমেলার অন্যতম জায়গা মা সেবকেশ্বরী কালীমন্দির। সারা বছরই তা বোঝা যায়। কালীপুজোর রাতে সেটা আরও স্পষ্ট করে বোঝা যায়।’’ নেপাল থেকেও ভক্তেরা আসেন বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন।
মন্দির কবে গড়ে উঠেছে, তা নিয়ে নানা মত রয়েছে। কেউ বলেন, কেন্দ্রীয় এক অফিসার তিস্তার জল মাপার কাজ কাজ করতে গিয়ে মায়ের আদল দেখতে পান একটি পাথরে। সেই পাথরই পূজিত হয়। ১৯৫২ সালে মন্দির তৈরি হয়। সেবকেশ্বরী মায়ের নতুন মূর্তি স্থাপিত হয়। পাশেই রয়েছে সেই পাথরটি। তবে মন্দির চত্বর বেশ ছোট। তাই তা বাড়ানোর জন্য জমির ব্যবস্থা করতে পর্যটনমন্ত্রী গৌতম দেবকে নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তিস্তার ধারের জাতীয় সড়ক থেকে ১০৭টি সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়। সেই সিঁড়িতেও ঠাঁই নেই এই দিন। কালীপুজো বলে কথা! তাই সেবক থানা থেকে সিভিক ভলান্টিয়ার, কনস্টেবল, অফিসাররা ভিড় সামাল দিতে শীতের মধ্যে ঘামছেন। রাস্তার ধারে ফুল-মালা, সন্দেশ, নারকেল কিনতে ঠেলাঠেলি। যেন মেলা বসেছে পাহাড়ি পথের ধারে।
পুরোহিতরা জানান, মন্দিরের পুজোয় চালকুমড়ো বলি দেওয়া হয়। কিন্তু কারও মানত থাকলে অন্য বলির ব্যবস্থা রয়েছে।
রাত সাড়ে ১০টা পুজো শুরু। গভীর রাতে অঞ্জলি হয়। আর এরপরে হিমের রাতে তখন চারদিকে ঝিঁঝি পোকার আওয়াজ। মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ পেরিয়ে ভেসে আসছে তিস্তার গর্জন। ভোরের আলো ফুটতে ফেরেন ভক্তরা।
সেবকের পাহাড়ি পথে ইতিমধ্যে বেশ ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে। তিস্তা পাড়ের মহানন্দা বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্যের মন্দিরের কাঁসর ঘন্টা, ঢাকের আওয়াজের ক্ষণিকের জন্য থামলেই শোনা যায় রাতচরা পাখির আওয়াজ। তিস্তার ছলাৎ। তাই হয়তো ওদলাবাড়ি থেকে জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, সব জায়গা থেকে শয়ে শয়ে ভক্তরা এখনও কালীপুজোর রাতে পুজো দেখতে হাজির থাকেন সেবকেশ্বরী কালীমন্দিরে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy