Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

দামাল বাইক, জরিমানার বদলে ‘গার্জেন কল’

একেই দিনকাল ভাল নয়! ধৃতকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও কম ঘটছে না। সে জন্য ইদানীং এক থানার পুলিশ কোনও অভিযুক্তকে গ্রেফতার করলে তাকে অন্য থানায় নিয়ে গিয়ে রাখছে। তাই বর্ষবরণের সময়ে বেপরোয়া বাইক আরোহীদের ধরাধরি কিংবা জরিমানার রাস্তায় হাঁটল না উত্তরবঙ্গের পুলিশ।

ফুলবাড়ি ব্যারাজ সংলগ্ন এলাকায় বাইক ধরেছে পুলিশ। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।

ফুলবাড়ি ব্যারাজ সংলগ্ন এলাকায় বাইক ধরেছে পুলিশ। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।

কিশোর সাহা
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:০৭
Share: Save:

একেই দিনকাল ভাল নয়! ধৃতকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও কম ঘটছে না। সে জন্য ইদানীং এক থানার পুলিশ কোনও অভিযুক্তকে গ্রেফতার করলে তাকে অন্য থানায় নিয়ে গিয়ে রাখছে। তাই বর্ষবরণের সময়ে বেপরোয়া বাইক আরোহীদের ধরাধরি কিংবা জরিমানার রাস্তায় হাঁটল না উত্তরবঙ্গের পুলিশ। জরিমানা করা কিংবা গারদে পোরার রাস্তা এড়িয়ে ‘গার্জেন কল’ করে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করলেন উত্তরের ৮ জেলার পুলিশ অফিসার-কর্মীদের অনেকেই।

তাতে যেমন কাজ হয়েছে। তেমনই জরিমানা না করে এমন ‘গাঁধীগিরি’ করার জন্য পুলিশকে কটাক্ষ করে দু-চার কথা শোনাতে ছাড়েননি কয়েকজন অভিভাবকও। তবে দু’দিনে ‘গার্জেন কল’-এর পরে বেপরোয়া বাইক আরোহীদের রাশ কিছুটা টানতে পারায় স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন প্রায় সব জেলার পুলিশকর্মীরা।

সরকারি সূত্রের খবর, রাজ্য পুলিশের উত্তরবঙ্গের এডিজি তথা আইজি এন রমেশবাবু নির্দেশ দিয়েছেন, উৎসবের সময়ে কমবয়সীরা ট্রাফিকের বিধি ভঙ্গের অভিযোগে ধরা পড়লে দুম করে জরিমানা কিংবা গ্রেফতার করার দরকার নেই। বরং অভিভাবকদের ফোন করে তাঁদের মাধ্যমেই সতর্ক করতে হবে। সেই মতোই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার বিকেলের মধ্যে উত্তরবঙ্গের নানা জেলায় অন্তত ৩৫০ জন বেপরোয়া বাইক আরোহীকে ধরে ‘গার্জেন কল’ করা হয়েছে। বেশির ভাগই স্কুল-কলেজের পড়ুয়া। আটকদের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে তাঁদের ফোনেই অভিভাবকদের ছেলের কীর্তির কথা জানানো হয়েছে অভিভাবকদের। ছেলেদের শাসন করারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পুলিশের দাবি, তাতে ‘ম্যাজিকের মতো’ কাজ হয়েছে। কয়েকজন অভিভাবক তো এমন ধমকেছেন যে, তাদের ছেলেমেয়েরা প্রায় ফোনেই হাত-পা ধরে ক্ষমা চেয়েছে।

পাশের জেলা জলপাইগুড়ির তিস্তা সেতুর ধারে দু’টি বাইকে ৬ জন গিয়ে বিয়ারের আসর বসিয়েছিল। সকলেই কলেজ পড়ুয়া। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পরে সে কী চেঁচামেচি। তাঁরা কোন দলের সঙ্গে যুক্ত তা ‘ঘোষণা করে’ হইচই। পুলিশ তরুণ-তরুণীদের ফোন নিয়ে অভিভাবকদের কাছে সব জানিয়ে কী করণীয় তা জানতে পরামর্শ চায়। এরপরে ফোনেই ৬ জনকে এমন বকাঝকা করেন বাড়ির লোকজন যে, সেখানেই দু‌ই তরুণী কান্নায় ভেঙে পড়েন। এক অফিসারের কথায়, ‘‘আমরা ১০০ টাকা জরিমানা করলে তা দিয়ে ফের অন্যত্র বসত। বাইক চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। গ্রেফতার করলে কোনও নেতা থানায় গিয়ে মরাল পুলিশিং করছি কি না, সেই প্রশ্নে হয়তো থানার দেওয়াল কাঁপিয়ে ধৃতকে ছাড়িয়ে নিতেন। তার চেয়ে এটাই ভাল হচ্ছে।’’

পুলিশের অন্য রকম অভিজ্ঞতাও হয়েছে। শিলিগুড়ির একটি পার্ক লাগোয়া এলাকা থেকে কয়েকজনকে বাইকে বসেই মদের আসর বসানোর অভিযোগ পুলিশ আটক করে। বাড়ির লোকজনকে ফোন করা হয়। ওই অফিসার জানান, মোবাইলের লাউড স্পিকার মোড-এ এক তরুণীর বাবাকে ফোন করেছিলাম। ও প্রান্ত থেকে বাবাকে মেয়ের উদ্দেশ্যে বলতে শুনলাম, ‘‘আরে তোকে যে হাতখরচ বাবদ এত টাকা দিই, তাতে তো বার-এ গিয়ে খেতে পারিস। এ সব পার্কে বসে মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি করিস কেন!’’ ওই দলের এক যুবকের বাবা তো ছেলেকে গ্রেফতার করে এক রাত থানায় রাখার জন্য অফিসারকে প্রায় নির্দেশ দিয়ে বসলেন। কেন আইন মেনে জরিমানা না করে গাঁধীগিরি করা হচ্ছে, তা নিয়েও তিনি প্রশ্ন তোলেন।

ইসলামপুর, কোচবিহার, রায়গঞ্জ, আলিপুরদুয়ারেও বষর্বরণের উদ্দামতা সামাল দিতে গিয়ে পুলিশ অফিসার-কর্মীদের নানা মজাদার অভিজ্ঞতা হয়েছে। যেমন ইসলামপুরে মাঝ রাতে অভিভাবকদের ফোন করায় তাঁরা প্রথমে আঁতকে উঠেছিলেন। পরে বিষয়টি বুঝতে পেরে নিজেরাই পুলিশের সামনে তুমুল বকাবকি করে ছেলেমেয়েদের নিয়ে গিয়েছেন। পুলিশ সূত্রের খবর, রাত দু’টোয় এক অভিভাবক ছেলের কাণ্ড শুনে তো ক্ষেপে গিয়ে এক অফিসারকে বলেন, ‘‘ছেলের মাথায় বোতল ভাঙা উচিত। ওঁর বাইকটা চিরতরে বাজেয়াপ্ত করে রাখুন।’’ যদিও পরে পুলিশ গাড়িতে তুলে ওই যুবককে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে। এক পুলিশকর্মী বাইকটি পৌঁছে দিয়েছেন।

বস্তুত, ‘নিউ ইয়ার পার্টি’ সামাল দিতে গিয়ে ধরাধরি, জরিমানা করার রাস্তায় না হেঁটে যে অনেক ঝামেলা যে এড়ানো গিয়েছে, তা মানছেন শাসক দলের অনেকেই। উত্তরের একাধিক জেলার প্রথম সারির নেতাদের অনেকেই একান্তে মানছেন, উৎসবের সময়ে বেচালের কারণে কাউকে ধরলে বাড়ির লোকজন দ্বারস্থ হলে তাঁকে ছাড়াতে থানায় ফোন করা কিংবা যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। বরং, পুলিশই আগে অভিভাবকদের ফোন করায় নেতাদের অনেকে নিজেরাও নিশ্চিন্তে উৎসবে মাততে পেরেছেন বলেও মেনেছেন তাঁরা। তবে জেলা পুলিশের প্রথম সারির অফিসারদের অনেকে জানিয়ে দিয়েছেন, যাঁদের গার্জেন কল করা হচ্ছে তাঁদের ঠিকানা রেখে দেওয়া হচ্ছে। কারণ, দ্বিতীয়বার একই অভিযোগে ধরা পড়লে তাঁদের জরিমানা হবেই বলে ওই পুলিশ অফিসাররা জানিয়ে দিয়েছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

police bikers gurdian call penalty kishor saha
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE