ত্রয়ী: (বাঁ দিক থেকে) নিকিতা, রাখি ও কোয়েল। নিজস্ব চিত্র।
ট্রেনের শৌচাগারে কেউ ফেলে রেখে গিয়েছিল একরত্তি মেয়েটিকে। তারপর পার হয়ে গিয়েছে বারোটা বছর। সেই মেয়ে এখন জলপাইগুড়ির সোনার মেয়ে। রাজ্যস্তরের তাইকোন্ড প্রতিযোগিতায় সোনার মেডেল পেয়েছে নবম শ্রেণির ছাত্রী কোয়েল দেবনাথ। প্রতিযোগিতা থেকে জলপাইগুড়ির হোমে ফিরে, কোয়েল মেডেল দেখাতে গিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলছিল সেদিন।
বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে উদ্ধার হয়েছিল বছর চারেকের রাখি ঘোষকে। এতগুলি বছরেও বাড়ির ঠিকানা মনে করতে পারেনি সে। বাবা-মায়ের মুখও আবছা। সোনার মেডেল হাতে পেয়ে রাখি বলেছিল, “মা-বাবা কোথায় আছেন জানি না। কোথাও তো আছে। ওঁরা কি কোনও দিন জানবে আমি একটা সোনার মেডেল পেয়েছি।”
পরিচারিকার কাজে বাড়ি থেকে পাঠিয়েছিল নিকিতা ওরাওঁকে। তখন ওর বয়স সাত-আট হবে। বাসন মাজা, ঘর মোছা ছেড়ে মন পড়ে থাকত খেলার মাঠে। তার শাস্তিও জুটত। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন উদ্ধার করে হোমে পাঠায় নিকিতাকে। সোনার মেডেল সেই নিকিতার গলাতেও।
জলপাইগুড়ির অনুভব হোমের এই তিন কিশোরী এখন সোনার মেয়ে। আসানসোলে সদ্য শেষ হওয়া রাজ্যস্তরের তাইকোন্ড প্রতিযোগিতায় তিনজনই সোনা পেয়েছে। আগামী মাসে জাতীয়স্তরের প্রতিযোগিতায় খেলতে যাবে তিনজন। অনুভব হোম থেকে পাঁচজন আবাসিক আসানসোলে খেলতে গিয়েছিল। সবাইকে সংবর্ধনা দেবে হোম কর্তৃপক্ষ। হোমের কর্ণধার দীপশ্রী রায় বললেন, “ওরা তিনজন আমাদের অনুপ্রেরণা। নিয়মিত হোমে তাইকোন্ডর প্রশিক্ষণ চলছে। আগামীদিনে আরও রাখি-নিকিতা-কোয়েল তৈরি করব আমরা।”
অনাথ, ভবঘুরে এবং উদ্ধার হয়ে আসা শিশু, কিশোরীদের রাখা হয় অনুভব হোমে। ক্লাব রোডের এই হোমে তাইকোন্ড প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছিল বছর তিনেক আগে। সেটাও ছিল আবাসিকদের মূলস্রোতে ফেরানোর এক উদ্যোগ। হোমের সুপার ডালিয়া রায়ের কথায়, “এক একটি মেয়ের ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাস রয়েছে। কেউ এসে সারাদিন মন মরা হয়ে থাকত, কেউ বা জানালার দিকেই তাকিয়েই বসে থাকত।”
হোমের মেয়েদের স্কুলে পাঠানো হয়। আর পাঁচটা সাধারণ ছাত্রীদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পায়। অন্যান্য হোমের মতো ছবি-আঁকা, গান শেখা, নাটক হয় অনুভবেও। তাতেও মন খারাপ পুরোপুরি লাঘব হয় না। কেউ বারবার জানতে চায়, নিজের বাড়ি কথা। কারও মনে ফিরে আসে পুরনো কোনও আতঙ্ক। সে সব কাটাতেই খেলার প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে বলে স্থির করে হোম কর্তৃপক্ষ। দীপশ্রী দেবীর কথায়, “হোমের মাঠেই প্রশিক্ষণ হয়। দেখেছি, কেউ খেলতে গিয়ে পরে গিয়ে হাসছে, কেউ বা সহ প্রতিযোগীর সাফল্যে হাততালি দিচ্ছে। বুঝি ওদের মনে পরিবর্তন এসেছে।”
শুধু নিজেদের ভাল থাকা নয়, রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতায় সোনা পেয়ে সমাজকেও জোরদার বার্তা দেওয়া গেল বলে দাবি দীপশ্রী দেবীর। একটা আক্ষেপ সুর শোনা গেল তাঁর গলায়, ‘‘যে বা যারা ট্রেনের শৌচাগারে, সীমান্তে অথবা কাজের বাড়িতে ছোট বাচ্চাদেরকে রেখে এসেছিল, তারা কি জানল সেই মেয়েদেরই গলায় এখন দুলছে সোনার মেডেল! ’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy