Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

নদীর চরে বসতি কী ভাবে, উঠছে প্রশ্ন

জল যতই বাড়ুক, তিস্তার বুকে দ্বীপের মতো জেগে থাকা চরের বাসিন্দা ভিটেমাটি ছেড়ে ত্রাণ শিবিরে যেতে রাজি নন। তবে এ দিন তিস্তার জলস্তরও নেমেছে। তাই দেখেই সেনাবাহিনীর জওয়ানদের ফিরিয়ে দিলেন দু’টি চর এলাকার কয়েকশো পরিবার। বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত গ্রাম পঞ্চায়েত ও প্রশাসনের কর্তাদের অনুরোধেও সাড়া দেননি তাঁরা।

তিস্তার জল ভাসিয়েছে বসতি। সামান্য আসবাবটুকু নৌকায় নিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা। ছবি: দীপঙ্কর ঘটক।

তিস্তার জল ভাসিয়েছে বসতি। সামান্য আসবাবটুকু নৌকায় নিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা। ছবি: দীপঙ্কর ঘটক।

বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য
জলপাইগুড়ি শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৫ ০২:৫২
Share: Save:

জল যতই বাড়ুক, তিস্তার বুকে দ্বীপের মতো জেগে থাকা চরের বাসিন্দা ভিটেমাটি ছেড়ে ত্রাণ শিবিরে যেতে রাজি নন। তবে এ দিন তিস্তার জলস্তরও নেমেছে। তাই দেখেই সেনাবাহিনীর জওয়ানদের ফিরিয়ে দিলেন দু’টি চর এলাকার কয়েকশো পরিবার।
বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত গ্রাম পঞ্চায়েত ও প্রশাসনের কর্তাদের অনুরোধেও সাড়া দেননি তাঁরা। ময়নাগুড়ির মতিয়ার চর এবং ডাবরি চর এলাকার বাসিন্দারা জানিয়ে দেন, জল যতই বাড়ুক দ্বীপের মতো জেগে থাকা দখল করা চর ছেড়ে কেউ ত্রাণ শিবিরে যাবেন না। নদীর দখলদারদের এমন বক্তব্যে অবাক পরিবেশপ্রেমী মহলে প্রশ্ন উঠেছে, কেন নদীকে দখল মুক্ত করে বিপদ এড়ানোর পথ খোঁজা হচ্ছে না! যদিও এদিন মালবাজার মহকুমার বাসুসুবা এবং চাঁপাডাঙা এলাকায় উদ্ধার কাজ চালায় সেনাবাহিনী। নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হয় কয়েকশো পরিবারকে। এদিকে ত্রাণ শিবিরগুলিতে খাবার নিয়ে ক্ষোভের পারদ চড়ছে। শৌচাগারের অভাবে বিপাকে পড়েছেন বিপন্ন মহিলারা।
বুধবার দিনভর সিকিম পাহাড়ে তেমন বৃষ্টি না হওয়ায় সন্ধ্যায় তিস্তা নদী থেকে লাল সঙ্কেত তুলে হলুদ সঙ্কেত দেওয়া হয়। ওই দিন গ্যাংটকে বৃষ্টি হয়েছে ২.৩ মিলিমিটার, চুংথাংয়ে বৃষ্টি হয়নি, মংগনে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল মাত্র ৪ মিলিমিটার। ওই কারণে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সমতলে তিস্তার জলস্তর নামতে থাকে। যদিও আশঙ্কার মেঘ কাটেনি। কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় সিকিম পাহাড় এবং সমতলে ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে। উত্তরবঙ্গ বন্যা নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যান গৌতম দত্ত বলেন, “পাহাড়ে বৃষ্টি হলে তিস্তার জলস্তর বাড়বে। এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।”

এদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত চর এলাকার উপর দিয়ে জলের স্রোত বয়েছে। ময়নাগুড়ি-ক্রান্তি পাকা সড়কের বিস্তীর্ণ এলাকা ছিল জলের তলায়। স্রোতের জন্য থার্মোকলের ভেলা নিয়ে যাতায়াত সম্ভব হয়নি। জেলা তৃণমূল সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তী বলেন, “বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে। দলের স্বেচ্ছাসেবীদের দেশি নৌকা, সার্চ লাইট নিয়ে তৈরি হয়ে রাত জেগে ত্রাণ শিবির পাহারা দিতে বলা হয়েছে।”

কিছুটা উঁচু থাকায় ময়নাগুড়ির মতিয়ার চর এবং ডাবরি চর এলাকা জলে তলিয়ে যায়নি। তবে চারপাশে উত্তাল নদী দেখেও সেখানকার বাসিন্দারা চর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে অস্বীকার করেন। বৃহস্পতিবার দুপুর নাগাদ স্পিড বোট নিয়ে সেনা জওয়ানদের একটি দল ওই দুটি চর এলাকায় যান। বাসিন্দারা তাঁদের ফিরিয়ে দেন বলে অভিযোগ। সেনা জওয়ানদের কাছে খবর পেয়ে বিকেল নাগাদ ময়নাগুড়ি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সুভাষ বসু স্থানীয় ভারপ্রাপ্ত বিডিও শুভঙ্কর রায়কে নিয়ে স্পিড বোটে দুটি নিয়ে চরে যান। সেখানে প্রায় তিন ঘণ্টা আলোচনার পরেও কেউ নদী এলাকা ছাড়তে রাজি হয়নি। সুভাষবাবু বলেন, “আশ্চর্যজনক ভাবে লোকগুলি বলছে জমি ছেড়ে চরের বাইরে যাবে না। বিপদের আশঙ্কার কথা জানিয়ে কোনও লাভ হয়নি। এর পরে এক সময় বিরক্ত হয়ে জমির কাগজ দেখাতে বলি। তখন চুপ করে যায়।” ওই ঘটনায় বিরক্ত জলপাইগুড়ির মহকুমাশাসক সীমা হালদার বলেন, “ওঁরা জেদ ধরে বসে আছেন। ভারপ্রাপ্ত বিডিও-কে এলাকায় পাঠিয়েছি। কিছু একটা ঘটে গেলে কী হবে!”

পরিবেশপ্রেমীরা প্রশ্ন তুলেছেন কেন নদী চর এলাকায় বসতি গড়তে দিয়ে ফি বছর এ ভাবে বিপদে পড়তে হচ্ছে প্রশাসনকে? হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের মুখপাত্র অনিমেষ বসু বলেন, “কেন নদীকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হবে না?” মহকুমাশাসক জানান, প্রশাসনের তরফে নদী চরে বসতি তৈরির অনুমতি দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। ওই বিষয়ে তাঁদের কিছু করার নেই। সেচ দফতরের কর্তারা জানান, ময়নাগুড়ি ও রাজগঞ্জ ব্লক এবং মালবাজার মহকুমায় তিস্তার সমস্ত চর দখল করে বসতি বেড়ে চলায় বিপদ বেড়েছে। কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না? সেচ কর্তাদের দাবি, “এটা প্রশাসনের কাজ।”

বছরের পর বছর চলা ওই চাপানউতরের সুবাদে এ বারও চর এলাকার অন্তত ৩০ হাজার মানুষ জলবন্দি। তাঁদের উদ্ধার করে বিভিন্ন স্কুলে রাখা হয়েছে। কয়েক হাজার পরিবার তিস্তা বাঁধে পলিথিনের তাঁবুর তলায় আশ্রয় নিয়েছেন। এদিন খাবার চেয়ে বিপন্ন মানুষের প্রশ্নের মুখে জেরবার হতে হয়েছে শাসকদল তৃণমূলের গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্যদের। চাতরারপাড় এলাকার তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য মঞ্জু রায় বলেন, “মহিলাদের শৌচাগার নেই। শিশুদের খাবার, পানীয় জল কিছুই মিলছে না। বিপাকে পড়েছি!”

দোমহনি-১ গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল উপপ্রধান হরিপদ রায় বলেন, “সময় মতো খাবার আসছে না।” বর্মণ পাড়ার বানভাসি ধনেশ রায়, অনিল বর্মণ, ফাল্গুনি বর্মণ, পুতুল বর্মণ জানান, বুধবার দুপুরে সামান্য চিঁড়ে গুড়, সন্ধ্যায় খিচুড়ি দেওয়া হয়। তার পরে খাবার মেলেনি। একই ছবি বাসুসুবা এলাকায়। ত্রাণ শিবির জুড়ে শিশুদের কান্না। মালবাজারের মহকুমাশাসক জ্যোতির্ময় তাঁতি বলেন, “এমনটা হওয়ার কথা নয়। খাবার দেওয়া হচ্ছে। বুধবার রাতে আড়াইশো প্যাকেট বেবি ফুড পাঠিয়েছি।” জলপাইগুড়ির মহকুমাশাসক বলেন, “ময়নাগুড়ি এবং রাজগঞ্জের ত্রাণ শিবিরগুলিতে পর্যাপ্ত খাবার, ওষুধ, পানীয় জল পাঠানো হয়েছে। এখন উদ্ধার কাজ চলছে ওই কারণে কিছু সমস্যা হতে পারে। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

biswajoyti bhattacharya river jalpaiguri teesta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE