জঞ্জালে ভরা: মহানন্দার বুকে রোজই জমছে শহরের আবর্জনা। যার চাপে গতি হারাচ্ছে নদী। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক
মহানন্দার পাড়ে দাঁড়িয়ে ফাঁস জাল থেকে মাছ ছাড়িয়ে দুই হাতে ধরে বাঁধ দিয়ে হেঁটে কাছেই ব্যারাজের কাছে গেলেন বুদ্ধিশা সরকার। ফুলবাড়ি ব্যারাজ। সেখানে মাছ ব্যবসায়ী ষষ্ঠী সরকারের দোকানে রাখতেই সেটিকে পাল্লায় চাপালেন দোকানি। সদ্য জল থেকে তোলা আমেরিকান রুইটি তখনও বারবার মুখ হাঁ করে দম নেওয়ার চেষ্টা করছে। এক কিলো ১০ গ্রাম। দেড়শো টাকা কেজি দরে ১৬৫ টাকা বুদ্ধিশাকে দিলেন তিনি। টাকাটা হাতে নিয়ে বুদ্ধিশা বলেন, ‘‘এই নদীই আমাদের মা-বাপ। আমাদের জীবন-জীবিকা, রোজগারের উপায়। এই নদীতেই আমাদের দিন চলে। অথচ এখন এই নদীতেই আবর্জনা ফেলা হচ্ছে দেদার।’’
তাঁর মতো রাঙাপানি এবং লাগোয়া এলাকার একশো মৎস্যজীবী মহানন্দার উপর নির্ভরশীল। অন্যান্য এলাকার আরও কিছু রয়েছে। রুই, কাতলা, বোয়াল, বরোলি, চেলা— কত মাছই ওঠে। শিলিগুড়ির অনেকে সাতসকালে এখানে এসে টাটকা মাছ কিনেও নিয়ে যান। এলাকার গোটা চারেক মাছের দোকানে মৎস্যজীবীরা সেই মাছ বেচে বাড়ি ফেরেন।
মহানন্দার এক রূপ মালদহে। আর এক রূপ শিলিগুড়িতে। মালদহে শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে নদী। কিন্তু শিলিগুড়িতে মহানন্দা শহরের জীবনরেখা। শিবখোলা থেকে এসে মহানন্দা অভয়ারণ্যের মধ্য দিয়ে বয়ে গুলমা, গাঁধীনগর হয়ে নদী শহরে ঢুকেছে। ওই বনাঞ্চলের পশুপাখিরাও তার উপরে নির্ভরশীল। বছর ৪০ আগে মহানন্দা ছিল দূরে দেখতে পাওয়া নীল পাহাড় থেকে বয়ে আসা নদী। টলটলে জল। নাব্যতাও ছিল। সেই নদী এখন বদলে গিয়েছে মানুষের চাপে। শহরের নদী খাতে টলটলে জল আর নেই। শহরের অপর প্রান্তে নৌকাঘাট এলাকার কাছে মহানন্দায় এসে মিশেছে বালাসনে। পরে লেধাইমারি নদী। তাদের জল বয়ে নিয়ে মহানন্দা ফুলবাড়ি হয়ে ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশে। পরে আবার ভারতে ঢুকে ধূমডাঙি এলাকা দিয়ে বয়ে গিয়েছে। অতীতে নদীর ধারে উর্বর জমিতে চাষাবাদ ছিল প্রধান জীবিকা। ব্যারাজ এবং বাঁধ তৈরির জন্য ফুলবাড়ি এলাকায় অনেক চাষের জমি নেওয়া হয়েছে। আবাদ ছেড়ে তখন অন্য কাজে ঝুঁকেছেন অনেকেই।
ফুলবাড়ি ব্যারেজের দক্ষিণ নদীর একদিকে লালদাস জোত অন্য দিকে জুগিভিটা। এলাকার কিছু লোক মহানন্দা খাত থেকে বালি পাথর তুলে ব্যবসাও করেন। বালিপাথর যথেচ্ছ তোলা হয় বালাসনেও। শিলিগুড়িতে মহানন্দা এবং বালাসনের বুকে কয়েক হাজার মানুষ বালি-পাথর তোলার শ্রমিক, ট্রাকের চালক, খালাসির কাজ করেন। চরেও আশ্রয় নিয়েছে অনেক পরিবার। ১৫-২০ বছর আগেও শিলিগুড়ির বুকে মহানন্দার চরে অবৈধ ভাবে জমি কেনাবেচার অভিযোগ উঠেছে। শহরের ১, ২, ৩ নম্বর ওয়ার্ডে নদীর চরে বসবাসকারীদের একাংশ খাটাল গড়ে রুজিরুটির সংস্থানও করছে। গত ১০ বছর ধরে ফুলবাড়ির পশ্চিমধনতলা এলাকায় মহানন্দার চর দখল হয়ে আসছে। খাস জমি কেনাবেচা করে অনেক বসতি গড়ে উঠছে এখনও। বসতি গড়ে উঠেছে তিনবাতির কাছে ‘হঠাৎ কলোনি’তে। বর্ষায় জল বাড়লে রাত জেগে কাটাতে হয় ভাগ্যলিপি মণ্ডল, পূজা মণ্ডলদের। ভাগ্যলিপিদের কথায়, ‘‘নদীকে আশ্রয় করেই তো বেঁচে রয়েছি। বসতি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের লাইন গিয়েছে। বাসিন্দাদের ভোটার কার্ড হয়েছে। শালুগাড়া, তুড়িবাড়ি এলাকায় মহানন্দার পাড়ে নদীর জমি কেনাবেচা করে অনেকে মোটা টাকাও কামিয়েছেন বলে শোনা যায়।’’
এই মহানন্দাই শহরবাসীর জন্ম-মৃত্যুর সাক্ষী। শিলিগুড়িবাসীর উৎসব অনুষ্ঠানের কেন্দ্র। তা সে দুর্গাপুজোর বিসর্জন হোক বা ছট পুজো। আবার শহরের মানুষের একাংশের আবর্জনা ফেলার জায়গাও। চরে প্রাতঃকৃত্য থেকে পচা গলা পশুর দেহ। নদীকে বাঁচাতে কত পরিকল্পনার কথা শোনা যায়। মহানন্দা অ্যাকশন প্ল্যান গড়ে তোলার বিষয়টিও গড়াতে চলল দু’দশক। হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার্স ফাউন্ডেশনের মুখপাত্র অনিমেষ বসু বলেন, ‘‘কত প্রজাতির মাছ এখন আর মহানন্দায় মেলে না। যে নদীকে ঘিরে আমাদের জীবনযাত্রা, তাকে ঠিক রাখতে, পরিষ্কার রাখতে আমরা এখনও ভাবি না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy